উচ্চ মাধ্যমিকের পর দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে কি করতে হবে?

উচ্চমাধ্যমিকের পরেই আসলে বাইরে পড়াশোনার করতে যাবার মোক্ষম সময়। কারণ অনেকেই জানেন না, বাইরের বেশিরভাগ দেশগুলোতে অনার্স কিংবা আন্ডারগ্রাডুয়েট লেভেলের পড়াশোনা শেষ করার পরেই লোকজন চাকরি করে। বাইরে দেশে মাস্টার্স করা লোকজন অনার্স করা লোকের থেকে অনেক কম হয় কারণ মাস্টার্স কেবল তারাই করে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা গবেষক হবেন।

আবার এমবিএ ডিগ্রীও সাধারণত তারাই করেন যাদের অনেক বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা কেবল প্রোমোশনের জন্য এমবিএ করেন কিংবা অনেকেই আছেন যারা নিজেদের ব্যবসায় দাঁড় করতে চান তাই ব্যবসায়িক ধারণা লাভের জন্য। তাই বাইরের যে কোনো দেশে অনার্স লেভেলে পড়াশোনা করতে গেলে আপনার মাথায় অনার্স পাস করার পর সেই দেশে চাকরির করার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

The 50 great books on education

আবার আসা যাক, উচ্চমাধ্যমিকের পর বাইরে পড়াশোনার কি রকমের প্রস্তুতি নিতে হবে তার সম্পর্কিত আলোচনায়। এই ক্ষেত্রে প্রস্তুতিটি মূলত ডকুমেন্টগুলো রেডি করার প্রস্তুতি। বাইরে আবেদন করতে হলে অনেক রকমের ডকুমেন্টের দরকার পরে। আবার সব ডকুমেন্টের দরকার সব দেশে সমান নয়। কিছু কিছু দেশে আবেদনের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি ডকুমেন্টেরও দরকার পরে।

তবে মোটের উপর, উচ্চমাধ্যমিকের পরে বাইরে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আপনাকে নিচের বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হবে—

১.পাসপোর্ট: বাইরে পড়াশোনা করতে যাবেন এই চিন্তা আপনার মাথায় আসার সাথে সাথেই আপনাকে দেখতে হবে আপনার পাসপোর্ট করা আছে কিনা। বাইরে আবেদনের ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই আবেদন করার কিছু সময় আগে থেকেই পাসপোর্ট করে রাখতে হবে যাতে করে আবেদনের ক্ষেত্রে আপনার বেশি তাড়াহুড়া করতে না হয়। আবার বেশি সময় হাতে রেখে পাসপোর্ট করলে আপনি পাসপোর্ট বানানোর ক্ষেত্রে বাড়তি খরচও কিছুটা কমাতে পারবেন।

২.কোথায় যেতে চাই: আমাদের দেশ থেকে মূলত দুই শ্রেণীর মানুষ বাইরে পড়াশোনা করতে যান— এক শ্রেণী যেতে চান ফুল বৃত্তি নিয়ে এবং অন্য শ্রেণী যেতে চান নিজের খরচে। এছাড়াও আরো একটি শ্রেণী রয়েছে যারা ইদানিং কম খরচে বাইরে থেকে ভালো পড়াশোনার সুযোগ খুঁজে থাকেন।

যারা ফুল বৃত্তি নিয়ে HSC এর পর দেশের বাইরে পড়তে যান,তারা নিচের বৃত্তিগুলো দেখতে পারেন.
* ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* ইন্দোনেশিয়া গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* মিশর গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* রাশিয়ান গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* আজেরবাইজান গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* চাইনিজ গভর্নমেন্ট বৃত্তি
*জাপান গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* রোমানিয়ান গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* হাঙ্গেরিয়ান গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* ব্রুনেই দারুসসালাম গভর্নমেন্ট বৃত্তি
* তুর্কিশ গভর্নমেন্ট বৃত্তি

বৃত্তিগুলোর আবেদনের সাধারণ সময়কাল ডিসেম্বর থেকে মে এর মধ্যে প্রতি বছর। তাই  এইচএসসি পাস করার পর আপনি হাতে বেশকিছু দিন সময় পাবেন। আবার যারা কম খরচে ভালো মানের লেখাপড়া করতে চান তারা মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া পার্লিস এবং ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া সারাওয়াক দেখতে পারেন।

ব্যবসায় এবং মানবিকের বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করতে আপনার টিউশন ফী এবং হোস্টেল ফী বাবদ মোট ৭-১০ লক্ষ টাকা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিষয়গুলোতে পড়াশোনা করতে ১০-১৪ লক্ষ টাকার মতো খরচ হতে পারে। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ই কিউএস টপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ এর ৮০০ এর মধ্যে রয়েছে।

৩. কি কি পরীক্ষা দেয়া লাগবে: উচ্চমাধ্যমিকের পরে বাইরে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মনে হয় সবচাইতে বেশি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে এই বিষয়টি নিয়ে কারণ আমাদের চারপাশে আমরা অনেক রকমের পরীক্ষার নাম শুনে থাকি জিআরই, জিম্যাট, টোফেল, স্যাট ইত্যাদি। কিন্তু খুশির ব্যাপার হচ্ছে আপনাকে এই সব কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না বাইরে যেতে।

কেবল আমেরিকার ক্ষেত্রে স্যাট লাগে তাও ক্ষেত্র বিশেষে। এছাড়া পৃথিবীর বাকি দেশগুলোতে আপনি কেবল IELTS পরীক্ষা দিয়েই আবেদন করতে পারবেন। আবার কিছু কিছু দেশ যেমন চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়া, তাইওয়ান এই দেশগুলোতে আবেদনের ক্ষেত্রে আপনাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নিজেদের ভাষায় পড়াশোনা করতে হবে। তাই এই সব ক্ষেত্রে IELTS এর দরকার নেই।

কিন্তু মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ইত্যাদি দেশগুলোতে আবেদনের ক্ষেত্রে আবার IELTS এর দরকার রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আবার একটি অপসন রয়েছে এমন আপনি যদি ওই সব দেশে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেদের ইংলিশ কোর্স করেন আপনার পড়াশোনার পাশাপাশি কিংবা তার আগে সেই ক্ষেত্রে IELTS স্কোর লাগে না আবেদন করতে। তবে এই ইংলিশ কোর্স বাবদ বেশকিছু টাকা
খরচ হবে আপনার।

৪. কি কি ডকুমেন্ট দরকার: আবেদনের ক্ষেত্রে আপনার মূলত লাগবে পাসপোর্ট, জম্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র (যদি থাকে না থাকলেও সমস্যা নেই), এসএসসির সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্ট, এসএসসির টেস্টিমোনিয়াল (ইংরেজিতে হলে ভালো না হলে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিতে হবে), এইচএসসির ট্রান্সক্রিপ্ট এবং সার্টিফিকেট (সার্টিফিকেট যদি পেয়ে থাকেন তাহলে ভালো, না হলেও সমস্যা নেই, তবে ট্রান্সক্রিপ্ট লাগবেই), এইচএসসির টেস্টিমোনিয়াল (ইংরেজিতে হলে ভালো না হলে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিতে হবে), ছবি (পাসপোর্ট সাইজ সাধারণত)।

মোটামুটি এইগুলো হচ্ছে ডকুমেন্ট। এছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষে আপনার IELTS স্কোর সার্টিফিকেট, অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট ইত্যাদিও লাগতে পারে। তবে আবেদনের সময় ডকুমেন্টের লিস্ট দেখে নিবেন কি কি ডকুমেন্ট চেয়েছে সেই অনুযায়ী প্রস্তুত করবেন। আমি কেবল একটি সাধারণ তালিকা দিলাম যাতে করে আপনি ডকুমেন্টগুলো প্রস্তুত করে রাখতে পারেন।

৫. ডকুমেন্টের নোটারি পাবলিককরণ: বাইরে আবেদনের ক্ষেত্রে ডকুমেন্টগুলোকে ফটোকপি করে এক রকম সত্যায়িত করণের প্ৰয়োজন পরে। এই প্রয়োজনটি নোটারি পাবলিক করলেই হয়ে যায়।

বাইরে বিশেষ করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, চীন ইত্যাদি দেশগুলোর ক্ষেত্রে আপনাকে আপনার যাবতীয় ডকুমেন্ট (সাধারণত পয়েন্ট ৪ এ বর্ণিত ডকুমেন্টগুলো) ফটোকপি করে তারপর নোটারি পাবলিক করতে হবে।

বাংলাদেশের সব জেলাতেই নোটারি পাবলিক করার জন্য উকিল রয়েছেন। তাছাড়া যারা ঢাকায় থাকেন যেতারা পল্টন, মোহাম্মদপুর টাউন হল, দৈনিক বাংলা মোড় ইত্যাদি জায়গাগুলো থেকে নোটারি পাবলিক করতে পারবেন এবং কোনো ডকুমেন্টকে চাইলে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে পারবেন।

৬. আবেদন করা: বাইরে আবেদনের ক্ষেত্রে আমি বরাবরই একদম কম খরচে আবেদনকে সাপোর্ট করি। সেই ক্ষেত্রে আপনি প্রথমেই অগ্রাধিকার দিবেন এমন জায়গাগুলোকে যেগুলোতে আপনি ফ্রিতে আবেদন করে পারবেন। ফ্রিতে আবেদন মানে আবেদনের ক্ষেত্রে আপনার কোনো আবেদন ফী লাগবে না এমন।

তবে আবার কিছু কিছু জায়গায় আছে যেগুলোতে আবেদনের জন্য আপনাকে ফ্রি দিতেই হবে।
সেই ক্ষেত্রে আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ক্রেডিট কার্ড বিষয়টি আজ কোনো এক কারণে বিলাস জাতীয় জিনিসের তালিকায় রয়েছে। যাই হোক, এই ক্ষেত্রে চিন্তার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতে আপনি ডাচ বাংলা ব্যাংকের শাখা পাবেন। বাইরে আবেদনের ক্ষেত্রে
ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি ভার্চুয়াল কার্ড। এটি মূলত প্রিপেইড সিস্টেমের কার্ড। মানে আবেদনের আগে আপনাকে এই কার্ডে টাকা রিচার্জ করে নিতে হবে। এই কার্ডের কোনো আপনার কোনো ব্যাংক একাউন্ট না থাকলেও চলবে কেবল পাসপোর্ট লাগবে।

৭. কিভাবে ডকুমেন্ট পাঠাবো: বাইরে আবেদনগুলোগুলো বেশিরভাগ অনলাইন নির্ভর কিন্তু তারপরও অনলাইনে আবেদন করে আবার সেই আবেদনের প্রিন্ট কপি এবং সাথে আরো কিছু ডকুমেন্ট (সাধারণত পয়েন্ট ৪ এ বর্ণিত) এক করে আপনাকে বাইরে পাঠাতে হবে অনেক ক্ষেত্রে।
এই ক্ষেত্রেই অনেকেই কিভাবে পাঠাবো কিংবা খরচ কত পড়বে তা নিয়ে চিন্তায় থাকেন। তবে আপনারা জেনে খুশি হবেন যে বাইরে আপনার ডকুমেন্টগুলো পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি কম খরচের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে।

আবার যারা ঢাকার বাইরে থাকেন তাদের জন্যও এই কুরিয়ার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি ঢাকার বাইরে থেকে যে কোনো ভালো কুরিয়ার যোগে আপনার ডকুমেন্টগুলো এদের কাছে পাঠিয়ে দিবেন এবং চার্জ বিকাশ করে দিয়ে দিবেন।

ওরা আপনার ডকুমেন্টগুলো বাইরে পাঠানোর পর আপনাকে একটি ট্র্যাকিং নম্বর মেসেজ করে দিবে যা দিয়ে আপনি মূলত আপনার ডকুমেন্টটি কোথায় রয়েছে তা দেখতে পারবেন।
এই কুরিয়ারের মাধ্যমে প্রেরণ করতে হলে আপনার খরচ পড়বে-

৮. সর্বমোট কত খরচ পড়তে পারে: বাইরে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আপনি যদি নিজের টাকায় পড়াশোনা করতে যান তাহলে আপনার খরচ একদম কম করে পড়বে ৬.৫ থেকে ৭.৫ লক্ষ টাকা ব্যবসায় শিক্ষা শাখা এবং মানবিকের বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করতে আর ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা যাবে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়াশোনা করতে।

তবে এই খরচের পরিমান মালয়েশিয়া এবং চীন হিসেব করে দেয়া। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই খরচ আরো বাড়ার সম্ভাবনা আরো বেশি বিশেষ করে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশগুলোতে। আবার যারা পড়াশোনা করবেন ফুল বৃত্তি নিয়ে তাদের ক্ষেত্রে ক্ষেত্র বিশেষে বিমান ভাড়া এবং কিছু হাত খরচ লাগবে তবে সব মিলে এই পরিমান ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজারের উপর পড়বে না বলে আশা করা যায়।

এইচএসসি পাস করার পর অনেকেই এই বিষয়গুলো জানেন না বলেই বাইরে আবেদন করতে সাহস পান না। কিন্তু আপনি যদি অনেক দূর যেতে চান, তাহলে বর্তমান যুগে বাইরে পড়াশোনা এইচএসসির পরই শুরু করা উচিত। আশা করছি আপনাদের বাইরে পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণ করতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটি আপনাদের সাহায্য করবে। সবার সাফল্য কামনা করছি। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন,
আর অন্যায়কে সর্বদা না বলুন, একে অন্যের সাহায্য করুন।

 

© Arefin Masuk. All rights reserved. Premium By FC Themes