গুনাহ কাকে বলে? গুনাহ-এর প্রকারভেদ. Gunah kake bole? Gunah er prokarved.

‘গুনাহ’ শব্দটি বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত হলেও এটি মূলত ফার্সি শব্দ।[1] গুনাহ বুঝাতে বাংলায় আরও একটি বহুল প্রচলিত শব্দ হচ্ছে পাপ। বাংলা অভিধানে এর অর্থ লেখা হয়েছে অন্যায়, কলুষ, দুষ্কৃতি ইত্যাদি।[2] আরবীতে গুনাহ বা পাপ বুঝানোর জন্য অনেকগুলো পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। যেমন, আল ইস্ম (الإثمُ), আল খাত্বা ও আল খাত্বীআহ্ (الخطأ والخطيئة), আল মা‘সিয়াহ্ (المعصيةُ), আল জুর্ম (الجرمُ), আয্ যান্ব (الذنبُ) ইত্যাদি।

এ সকল পরিভাষার মাঝে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকলেও মূলত যা বুঝায় তা হলো, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর আদেশ পালন না করা বা তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করা ও তাঁদের নিষেধকৃত কাজ করা, তা প্রকাশ্যেই হোক বা গোপনে হোক।

 700,000+ Best Nature Pictures & Images in HD

গুনাহ-এর প্রকারভেদ

গুনাহ বা পাপগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় :

১. কাবীরা গুনাহ বা বড় গুনাহ; যেমন শির্ক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা, বিদ্‘আত করা, মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, যাদু করা, সুদ খাওয়া ইত্যাদি।

২. সগীরা গুনাহ বা ছোট গুনাহ; যেগুলো কাবীরা গুনাহ নয় এমন গুনাহ; যেমন, পরনারীর প্রতি দ্বিতীয়বার তাকানো ইত্যাদি।

কাবীরা গুনাহের তালিকা

কাবীরা গুনাহের কোন সুনির্দিষ্ট তালিকা কুরআন ও হাদীসে একই জায়গায় ধারাবাহিকভাবে আসেনি। বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস গবেষণা করে ‘আলিমগণ কাবীরা গুনাহের তালিকা প্রণয়ন করেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন ইমাম হাফিয শামসুদ্দীন আয্ যাহাবী (রহিমাহুল্লাহ)[1]। তিনি তার কিতাব ‘‘আল কাবায়ির’’-এর মধ্যে অর্ধশতাধিক কাবীরা গুনাহের তালিকা দিয়েছেন। সম্প্রতি সাউদী আরবের বিখ্যাত ‘আলিম শাইখ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন ‘আবদুল্লাহ আত্ তুয়াইজিরী একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন যা তার রচিত ইসলামী ফিকহ বিশ্বকোষ-এর ১৬ তম পর্বে ‘‘কিতাবুল কাবায়ির’’ নামে উল্লিখিত হয়েছে। নিম্নে সেই তালিকাটি পেশ করা হলো। উল্লেখ্য যে, তিনি তার লেখায় প্রতিটি কাবীরা গুনাহর দলীল উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমরা কলেবর বৃদ্ধির শঙ্কায় দলীলগুলোর মূলপাঠ (Text) উল্লেখ না করে শুধু সূত্র (রেফারেন্স) উল্লেখ করে দিয়েছি। যাতে করে কোন পাঠক চাইলে সেই সূত্র ধরে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।[2]

(ক) অন্তরের কাবীরা গুনাহ :

১. কুফর[3]

২. শির্ক[4]

৩. অহংকার[5]

৪. মুনাফিক্বী[6]

৫. রিয়া বা লোক দেখানো ‘আমল[7]

৬. যাদু করা[8]

৭. অশুভ লক্ষণ বিশ্বাস করা[9]


(খ) জ্ঞান ও জিহাদ সংক্রান্ত কাবীরা গুনাহ :

৮. আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশে জ্ঞান অর্জন করা[10]

৯. জ্ঞান গোপন করা[11]

১০. আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর উপর মিথ্যা আরোপ করা[12]

১১. জ্ঞান অনুযায়ী ‘আমল না করা[13]

১২. আল্লাহর পথে দা‘ওয়াত দানে বিরত থাকা বা দা‘ওয়াতী কাজ ছেড়ে দেয়া[14]

১৩. সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে নিষেধ করা হতে বিরত থাকা বা তা ছেড়ে দেয়া[15]

১৪. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা হতে বিরত থাকা বা তা ছেড়ে দেয়া[16]

১৫. ভ্রান্তদলের পক্ষে যুদ্ধ করা[17]

১৬. যুদ্ধে মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদেরকে সাহায্য করা[18]


(গ) ‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে কাবীরা গুনাহ

১৭. পেশাব হতে বেঁচে/সতর্ক না থাকা (যথাযথভাবে পরিচ্ছন্ন না থাকা)[19]

১৮. সলাত পরিত্যাগ করা[20]

১৯. সলাতে ইমামের পূর্বে কোন কাজ করা[21]

২০. সলাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করা[22]

২১. যাকাত দানে বাধা দেয়া বা যাকাত না দেয়া[23]

২২. সিয়াম পরিত্যাগ করা[24]

২৩. হাজ্জ পরিত্যাগ করা[25]

২৪. আল্লাহকে স্মরণ না করা[26]


(ঘ) শাসন-প্রশাসন ও লেনদেনের ক্ষেত্রে কাবীরা গুনাহ

২৫. আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান ছাড়া শাসন/বিচার করা[27]

২৬. শাসক কর্তৃক নাগরিকদের ধোঁকাদান বা নাগরিকদের সাথে প্রতারণা করা[28]

২৭. অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করা[29]

২৮. সূদ খাওয়া[30]

২৯. ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ ও অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা[31]

৩০. জুয়া খেলা[32]

৩১. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া[33]

৩২. শরীয়তের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা[34]

৩৩. স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে মূল্য গ্রহণ করা[35]

৩৪. অন্যায়ভাবে মালিকানা দাবি করা[36]

৩৫. মানুষের সাথে প্রতারণা করা[37]

৩৬. মিথ্যা ক্বসম করে পণ্য বিক্রয় করা[38]

৩৭. অন্যায় উদ্দেশে পণ্য মজুদ করা[39]

৩৮. মিথ্যা শপথ করা[40]

৩৯. দোষ গোপন ও মিথ্যা কথা বলে পণ্য বিক্রয় করা[41]

৪০. হারাম ব্যবসা করা[42]

৪১. যুলুম করে (অন্যায়ভাবে) কোন কিছু গ্রহণ করা[43]

৪২. সাক্ষ্য গোপন করা[44]

৪৩. জমিনের সীমানা/খুঁটি অন্যায়ভাবে পরিবর্তন করা[45]


(ঙ) পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক কাবীরা গুনাহ

৪৪. অধীনদের ওপর অত্যাচার করা[46]

৪৫. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া[47]

৪৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা[48]

৪৭. কারো বংশ নিয়ে কটাক্ষ করা[49]

৪৮. বিনা কারণে মুসলিমের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা[50]

৪৯. মন্দ নামে ডাকা[51]

৫০. প্রতিবেশীর সাথে দুর্ব্যবহার করা[52]

৫১. মানুষকে কষ্ট দেয়া[53]

৫২. এমন কথা বলা যা বললে আল্লাহ তা‘আলা রাগান্বিত হন[54]

৫৩. মুসলিমকে কাফির বলা[55]

৫৪. বিনা প্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তি করা[56]

৫৫. স্বামীর অবাধ্য হওয়া[57]

৫৬. স্ত্রীর ওপর অত্যাচার করা[58]

৫৭. স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয়া[59]

৫৮. মুত্‘আহ্ (সাময়িক চুক্তিভিত্তিক)বিবাহ করা[60]

৫৯. গায়রে মাহরাম (যাদের সাথে বিবাহ বৈধ) মহিলার সাথে বিবাহহীন অবস্থায় নির্জনে অবস্থান করা[61]

৬০. সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান না করা[62]

৬১. দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করা[63]


(চ) চারিত্রিক কাবীরা গুনাহ

৬২. মিথ্যা বলা[64]

৬৩. সতী-সাধ্বী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া[65]

৬৪. গীবত ও চোগলখোরী করা[66]

৬৫. আমানতের খিয়ানত করা[67]

৬৬. অভিশাপ দেয়া[68]

৬৭. সাহাবীদেরকে গালি দেয়া[69]

৬৮. অসমীচীন ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা[70]

৬৯. সীমালঙ্ঘন করা[71]

৭০. অত্যাচার ও শত্রুতা করা[72]

৭১. মারাত্মক ঝগড়া বিবাদ করা[73]

৭২. অশ্রাব্য গালিগালাজ করা[74]

৭৩. হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা[75]

৭৪. গর্ব ও অহংকার করা[76]

৭৫. কৃপণতা করা[77]

৭৬. বাড়াবাড়ি করা[78]

৭৭. বিশ্বাসঘাতকতা করা[79]

৭৮. অপকৌশল ও ঠকবাজি করা[80]

৭৯. অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করা[81]

৮০. আত্মহত্যা করা[82]

৮১. অপচয় করা[83]

৮২. অপব্যয় করা[84]

৮৩. স্বেচ্ছাচারিতা করা[85]

৮৪. গোয়েন্দাগিরি করা[86]

৮৫. অন্যায়ভাবে রাগান্বিত হওয়া[87]

৮৬. অশ্লীল ভাষায় কথা বলা[88]

৮৭. আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ মনে করা[89]

৮৮. আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া[90]

৮৯. অপরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা[91]

৯০. উপকার করে খোঁটা দেয়া[92]

৯১. আল্লাহর ওয়ালীদের সাথে শত্রুতা করা[93]

৯২. আল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করা[94]

৯৩. হারামের মধ্যে ডুবে থাকা[95]

৯৪. ওয়াদা ভঙ্গ করা[96]

৯৫. মাদকাসক্ত হওয়া[97]

৯৬. যিনা বা ব্যভিচার করা[98]

৯৭. সমকামিতায় লিপ্ত হওয়া[99]

৯৮. চুরি করা[100]

৯৯. ডাকাতি করা[101]

১০০. চেহারায় দাগ কাটা ও চিহ্ন দেয়া[102]

১০১. সোনা-রূপার পাত্রে পানাহার করা[103]

১০২. পুরুষের রেশম বা স্বর্ণের পোশাক পরিধান করা[104]

১০৩. অস্ত্র দিয়ে কারো দিকে ইশারা করা[105]

১০৪. জানা সত্ত্বেও অন্যকে পিতা দাবী করা[106]

১০৫. বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ও বাজনা শোনা[107]

১০৬. কবরের উপর বসা[108]

১০৭. টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পড়া[109]

১০৮. পুরুষদের মহিলার বেশ এবং মহিলাদের পুরুষদের বেশ ধারণ করা[110]

১০৯. ছায়ায় ও রাস্তায় প্রসাব-পায়খানা করা[111]

১১০. মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কোন জন্তুকে আটকে রাখা[112]

১১১. কোন জন্তুকে তীর বা গুলি লাগানোর ট্রেনিং-এর লক্ষ্য বস্তু বানানো[113]

১১২. বিনা কারণে কুকুর পোষা[114]

১১৩. মৃত জন্তু ও রক্ত খাওয়া[115]

উল্লেখ্য যে, উপর্যুক্ত তালিকায় বর্ণিত গুনাহগুলোর মধ্যে শাস্তির পরিমাণ ও ভয়ংকরিতার দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। এগুলোর কোনটি পৃথিবীতে দন্ডনীয় অপরাধ আবার কোনটির পৃথিবীতে দন্ড উল্লেখ নেই। আবার কিছু গুনাহ কাবীরা গুনাহ কিনা তা নিয়ে ‘আলিমগণের মধ্যে সঙ্গত কারণেই মতবিরোধ রয়েছে। তাছাড়া যেহেতু এখানে সংক্ষেপে শুধু গুনাহগুলোর শিরোনাম উল্লেখ করা হয়েছে সেহেতু উল্লিখিত শিরোনামগুলোর সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা বোঝা জরুরি। নতুবা ভুল বোঝার আশঙ্কা রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য সংশিস্নষ্ট বইপত্র পড়ে ও ‘আলিমদের জিজ্ঞেস করে স্পষ্ট করে বুঝে নেয়া উচিত।

 

 

© Arefin Masuk. All rights reserved. Premium By FC Themes