Posts

শিরক কী এবং কাকে বলে? Sirok ki abong kake bole. dinislam.xyz

‘শির্ক’-এর দু’টি অর্থ রয়েছে : এক. সাধারণ অর্থ, আর তা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ করা। সমকক্ষ বলতে এখানে মুক্ত শরীকানা বুঝানো হয়ে...

ভূমিকা

সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্যই, যিনি ব্যতীত আমাদের অপর কোন প্রতিপালক ও উপাস্য নেই। দরূদ ও সালাম সেই রাসূল, তাঁর পরিবার ও সাহবীদের প্রতি, যাঁর অনুসরণ, আনুগত্য ও ভালোবাসা ব্যতীত আমাদের ইহকাল ও আখেরাতে শান্তি ও মুক্তির কোনই উপায় নেই। কেয়ামত দিবস পর্যন্ত যারা এককভাবে আল্লাহ তা‘আলাকেই তাদের প্রতিপালক ও উপাস্য হিসেবে গণ্য ক’র এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আল্লাহ তা‘আলার সর্বশেষ রাসূল হিসেবে মনে করে নিঃশর্তভাবে কেবল তাঁরই আদর্শের অনুসরণ ও অনুকরণ করে, তাদের উপরেও আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।

অতঃপর, আমরা মৃত্যুর সাথে সাথে এমন এক জগতে পদার্পণ করবো যেখানে চিরস্থায়ী শান্তি আর অনাবিল আনন্দ কেবল তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে, যারা সেখানে সঠিক ঈমান ও ‘আমলের অধিকারী বলে স্বীকৃতি লাভে ধন্য হবে। আর চিরস্থায়ী শাস্তি আর অকল্পনীয় দুঃখ ও দুর্দশা কেবল তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে, যারা সেখানে শির্কের মত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধে দণ্ডিত হবে।

এ পৃথিবী হচ্ছে মানুষের আখেরাতে শান্তিময় জীবন লাভের কর্ম ক্ষেত্র। মানুষ যাতে এখানে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদে বিশ্বাসী হয়, সে-জন্যে রয়েছে তাঁর নানারকম আয়োজন। আমরা রূহ জগতে থাকাকালে তিনি যেমন এ-জন্য আমাদের নিকট থেকে তাঁর রুবূবিয়্যাতের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত স্বীকৃতি নিয়েছেন, তেমনি আমাদেরকে এখানে সৃষ্টি করার সময়ও তাঁকে স্বীকৃতি দানের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। আবার যখনই মানুষেরা পারিপার্শ্বিক বিবিধ কারণে তাঁর তাওহীদ থেকে বিচ্যুত হয়ে তাঁর রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতে শির্কে লিপ্ত হয়েছে, তখনই তিনি তাদের হেদায়তের জন্যে যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন নবী ও রাসূল। তাঁদের সাথে দিয়েছেন হেদায়তের অমিয় বাণী। এ ধারাবাহিকতায় বিশ্ব মানবতার হেদায়তের জন্যে সর্ব শেষ রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে। তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর সর্বশেষ বাণী আল-কুরআন। যার প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লে­ষণ তিনি করেছেন তাঁর সুন্নাতের মাধ্যমে। যারাই তাঁকে ভালবেসে নিঃশর্তভাবে এ দু’য়ের অনুসরণ ও অনুকরণ করবে, তারাই হবে সেখানে সফলকাম। কিন্তু মানুষের এ সফলতার সম্মুখে অন্তরায় হচ্ছে তাদের চির শত্রু শয়তান। আদম আলাইহিস সালাম-কে সেজদা না করার ফলে যেদিন সে আল্লাহর অভিসম্পাত প্রাপ্ত হয়েছিল, সেদিনই সে আদম সন্তানদেরকে তার মতই অভিশপ্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিল। সে বলেছিল :

﴿قَالَ فَبِمَآ أَغۡوَيۡتَنِي لَأَقۡعُدَنَّ لَهُمۡ صِرَٰطَكَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ١٦ ثُمَّ لَأٓتِيَنَّهُم مِّنۢ بَيۡنِ أَيۡدِيهِمۡ وَمِنۡ خَلۡفِهِمۡ وَعَنۡ أَيۡمَٰنِهِمۡ وَعَن شَمَآئِلِهِمۡۖ وَلَا تَجِدُ أَكۡثَرَهُمۡ شَٰكِرِينَ ١٧ [الاعراف: ١٦، ١٧]

‘‘আপনি যেমন আমাকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করলেন তেমনি আমিও অবশ্য (এ আদমের সন্তানদেরকে) পথভ্রষ্ট করার জন্য আপনার সরল পথে বসে থাকব, অতঃপর তাদের সমুখ, পশ্চাৎ, ডান ও বাম দিক থেকে তাদের কাছে আসব। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।’’[1]

বস্তুত শয়তান তার এ সংকল্প বান্তবায়ন করার জন্যে নানারকম অপকৌশল গ্রহণ করে চলেছে। আর সে সব অপকৌশলের মাধ্যমে সে বনী আদমকে জড়িত করেছে বিবিধ রকমের অপরাধমূলক কর্মে। যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধ হচ্ছে শির্ক। এ শির্কজনিত কারণেই সে অতীতের কাওমে নূহ, ‘আদ ও ছামূদ...ইত্যাদি জনপদের লোকদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। সৃষ্টিকর্তা, জীবন-জীবিকা, মৃত্যু ও সব কিছুর মূল পরিচালক হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকে স্বীকৃতিদানকারী, দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারীর দাবীদার, কা‘বা শরীফের খাদেম কুরায়শ ও আরব জনপদের লোকদেরকেও সে এ শির্কের মাধ্যমেই পথভ্রষ্ট করেছিল। তাদেরকে কতিপয় সৎমানুষ এবং লাত, উজ্জা ও মানাত নামের কাল্পনিক দেবীসমূহ ছাড়াও আরো অসংখ্য প্রতিমা ও দেব-দেবীকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের কোন কোন বৈশিষ্ট্যে শরীক বলে ধারণা দিয়ে তাদের উপাসনায় লিপ্ত করেছিল। আল্লাহর অলি ও সে-সব দেব-দেবীকে আল্লাহ তা‘আলা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ও সুপারিশকারীর ভূমিকা পালনকারী বলেও তাদেরকে ধারণা দিয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যস্থতা ও সুপারিশ পাওয়ার নিমিত্তে আল্লাহর উপাসনার পাশাপাশি এদেরও নানাবিধ উপাসনা করতে অভ্যস্থ করেছিল। তৎকালে হাতে গোণা কিছু লোক ব্যতীত অবশিষ্ট সকল লোকদেরকেই বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে শয়তান তার অতীত সংকল্পকে বান্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল। সে জন্য কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার সময়ের মানুষের ঈমান ও ‘আমলের শোচনীয় অবস্থা বিচারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছিলেন :

﴿ وَلَقَدۡ صَدَّقَ عَلَيۡهِمۡ إِبۡلِيسُ ظَنَّهُۥ فَٱتَّبَعُوهُ إِلَّا فَرِيقٗا مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٢٠﴾ [سبا: ٢٠]

‘‘আর শয়তান তাদের উপর তার ধারণা সত্যে পরিণত করেছিল। ফলে তাদের মধ্যে মু’মিনদের একটি দল ব্যতীত সকলেই তার পথ অনুসরণ করেছিল।’’[2]

তবে আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহে সর্বশেষ নবীর শুভাগমন এবং তাঁর ও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীদের সুযোগ্য নেতৃত্বে ইসলামের জয়যাত্রার ফলে আরব বিশ্বসহ এর পার্শ্ববর্তী পারস্য ও রোমান অঞ্চল থেকে শির্ক বিতাড়িত হয়ে সেখানে তাওহীদের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাওহীদের অমিয় বাণী। যার ফলে ছিন্ন হয়েছিল শয়তানের দীর্ঘ দিনের পাতানো চক্রান্তের জাল। আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ মানুষ শয়তানের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে পরিণত হয়েছিল এক আল্লাহর দাসে।

সভ্যতার উত্থান ও পতন এটি যেন ইতিহাসের একটি অমোঘ বিধান। তাই এ বিধানের হাত থেকে ইসলামও রক্ষা পায়নি। অতীতের বিভিন্ন জাতির লোকেরা যেমন শয়তানের চক্রান্তে পড়ে ধীরে ধীরে সঠিক দ্বীন পালন থেকে বিচ্যুত হয়ে পুনরায় শির্কে নিমজ্জিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি ইসলামের পরবর্তী অসংখ্য অনুসারীরাও শয়তানের চক্রান্তে পড়ে ধীরে ধীরে সঠিক দ্বীন পালন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। শয়তান অতীতের মানুষদেরকে যে-সব ধ্যান-ধারণা দিয়ে ও অপকৌশল প্রয়োগ করে বিভ্রান্ত করে আল্লাহর রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতে শির্কে লিপ্ত করেছিল, সে সব ধ্যান-ধারণা ও অপকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমেই সে অসংখ্য মুসলিমকেও আল্লাহর রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতে শির্কে লিপ্ত করেছে। তাই শির্কের মত জঘন্য অপরাধে আজ বিশ্বের অসংখ্য মুসলিম জর্জরিত। প্রবল প্রতাপের সাথে যে-সব স্থানে ইসলাম তার তাওহীদী চিন্তাধারা নিয়ে প্রবেশ করে শির্ককে বিদায় জানিয়েছিল, বহুযুগ পূর্বেই সে সব স্থানের সাধারণ মুসলিমদের মাঝে তাওহীদী চিন্তার পাশাপাশি শির্কও পুনরায় আপন স্থান করে নিয়েছে। সে হিসেবে আমাদের দেশে তাওহীদের অবস্থা যে কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এখানে যেমন ইসলাম এসেছে অনেকটা ধীরগতিতে, তেমনি আসার পথে প্রভাবিত হয়েছে ভারতীয় হিন্দু বৈরাগ্যবাদের বিষক্রিয়ায়। যার ফলে এদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণের প্রাক্কালে প্রকৃত তাওহীদ সম্পর্কেই যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারে নি। যারা পেরেছিল তাদের পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ও এখানে বৃটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সে জ্ঞান বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি। যার ফলে দেখা যায়, যে সব আলেম ও অলিগণ এদেশে এসেছিলেন শির্ক বিনাশ করে তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে, সময়ের পরিবর্তনে শয়তানের চক্রান্তে পড়ে তাঁদের ভক্ত ও সাধারণ অজ্ঞ মুসলিমদের দ্বারা স্বয়ং তাঁদের কবর ও মাযারসমূহই শির্ক চর্চা করার একেকটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর রহমতে ধীরে ধীরে ইসলামী জ্ঞানের চর্চা পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে এ সব মাযার ও কবর সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা অনেকটা দূরীভূত হলেও এখনও সাধারণ মানুষের অন্তর থেকে অলিদের ব্যাপারে শির্কী চিন্তাধারার অবসান ঘটে নি। অলিদের মাযার কেন্দ্রিক ছাড়াও এ দেশের সাধারণ মুসলিমদের মাঝে আরো বিভিন্ন উপায়ে শির্কী কর্মকাণ্ড অহরহ হয়েই চলেছে।

শির্ক মানুষের ধ্যান-ধারণা, কর্ম ও অভ্যাসের মধ্যকার যেখানেই হোক, এটি এমন একটি বিষক্রিয়া যে, যদি কারো জীবনে কখনও একটি মাত্র শির্কও সংঘটিত হয় এবং তাত্থেকে সে ব্যক্তি তাওবা করে মরতে না পারে, তা হলে এই একটি শির্কই তার ঈমান ও জীবনের যাবতীয় সৎকর্মকে নিষ্ফল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। এ ধরনের লোকদের ঈমান ও ‘আমলের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ قُلۡ هَلۡ نُنَبِّئُكُم بِٱلۡأَخۡسَرِينَ أَعۡمَٰلًا ١٠٣ ٱلَّذِينَ ضَلَّ سَعۡيُهُمۡ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَهُمۡ يَحۡسَبُونَ أَنَّهُمۡ يُحۡسِنُونَ صُنۡعًا ١٠٤ [الكهف: ١٠٣، ١٠٤]

‘‘বলুন : আমি কি তোমাদেরকে সে-সব লোকদের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক থেকে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সে-সব লোক, যাদের পার্থিব জীবনের প্রচেষ্টা বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে তারা সৎকর্ম করছে।’’[3]

এ পৃথিবীতে আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি দান, এর সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। এটি এমন একটি কাজ যে, এনিয়ে কারো দ্বিমত পোষণ বা এ নিয়ে মতবিরোধ করারও কোন অবকাশ নেই। সে জন্য মহান আল্লাহ বলেন :

﴿أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ﴾ [الشورى: ١٣]

‘‘তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার মতবিরোধ করো না।’’[4]

এ দ্বীন প্রতিষ্ঠার মূল কথা হচ্ছে কালিমায়ে তাওহীদকে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা ও এর উপর মৃত্যু পর্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা। আর এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার দাবী হচ্ছে এ তাওহীদকে বিনষ্টকারী শির্ক নামের মহা অপরাধটি কী এবং সমাজে এটি কেন সংঘটিত হয়, সে সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখা। তা না হলে যে কোন সময় শয়তানের খপ্পরে পড়ে যে কারো ঈমান ও জীবনের সৎকর্মের যাবতীয় সাধনা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এ হেন গুরুতর পরিণতির হাত থেকে যেমন নিজেকে রক্ষা করা আবশ্যক, তেমনি এত্থেকে দেশবাসী ও বিশ্বের সকল মুসলিমকেও রক্ষা করা আবশ্যক। আর এ আবশ্যকতাবোধই আমাকে এ ব্যাপারে একটি গবেষণাকর্ম চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। মানব কল্যাণমূলক এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাকর্মের তৌফিক দানের জন্য আমি সর্বাগ্রে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। অতঃপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ, একাডেমিক শাখাসহ অন্যান্য শাখার কর্মকর্তা ও কমর্কচারীবৃন্দের, যাঁরা আমাকে ‘‘বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে প্রচলিত শির্ক ও বেদ‘আত : একটি সমীক্ষা’’-এ শিরোনামের উপর পি. এইচ. ডি.গবেষণা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। আমার এ গবেষণাকর্মটি আরবী ভাষায় সম্পাদিত হওয়ার কারণে দেশের জনগণের অধিকতর উপকারের স্বার্থে এর শির্ক অংশটিকে বাংলা ভাষায় প্রকাশের জন্য আমি তাতে প্রয়োজনীয় কিছু সংযোজন ও বিয়োজন করে এর শিরোনাম দিয়েছি ‘‘শির্ক কী ও কেন?’’। আশা করি, আল্লাহ চাহে তো এ বইখানা পাঠ করলে ইসলাম থেকে বহিষ্কারকারী ও আমল বিনষ্টকারী এ জঘন্য অমার্জনীয় অপরাধ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত হওয়া সম্ভব হবে এবং সমাজে তা সংঘটিত হওয়ার জন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কোন্ কোন্ কারণকে দায়ী করা যায়, সে সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল হওয়া সম্ভব হবে।

আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদকে সংরক্ষণ, এর প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করাই হচ্ছে একজন মু’মিনের জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমি আমার এ বইখানা লেখার প্রয়াস চালিয়েছি। এতে উপস্থাপিত বক্তব্য ও তথ্যাবলী সঠিক হলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকবে; আর অনিচ্ছাকৃতভাবে কোথাও কোন ভুল হলে তা হবে আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল-ভ্রান্তি মার্জনা করেন এবং আমার এ প্রয়াসকে কবুল ও মঞ্জুর করেন; এর দ্বারা তিনি যেন বিপথগামী মুসলিমদেরকে সরল ও সঠিক পথের সন্ধান দান করেন।এর ওসীলায় যেন আমাকে, আমার পিতা-মাতা, পরিবার, সন্তানাদি, মু’মিন ও মু’মিনাত আত্মীয় স্বজন এবং এ বইখানা লিখতে ও তা প্রকাশ করতে যারা নিষ্ঠার সাথে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের সকলকে আখেরাতে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে জান্নাত নসীব করেন, আমীন ছুম্মা আমীন।


[1] . আল-কুরআন; সূরা আ‘রাফ : ১৭, ১৮।

[2] . আল-কুরআন, সূরা সাবা : ২০।

[3] . আল-কুরআন, সূরা কাহাফ : ১০৪-১০৫।

[4]. আল-কুরআন.সূরা : শুরা : ১৩।

 শির্ক ও যুগে যুগে এর বহিঃপ্রকাশ

পাপ মূলত দু’প্রকারঃ একটি বড় আর অপরটি ছোট। আবার বড় পাপের রয়েছে অনেক প্রকার। তবে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে তন্মধ্যে তিনটি পাপ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুতর। আবু বকরাঃ নুফাই‘ ইবন হারিছ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

«أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الكَبَائِرِ؟» ثَلاَثًا، قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ - وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ - أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ»، قَالَ: فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا: لَيْتَهُ سَكَت

‘‘হে আমার সহচরগণ! আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় অপরাধ সম্পর্কে সংবাদ দেব’’? ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি তিনবার বলেন। আমরা বললাম : হে আল্লাহর রাসূল আপনি বলুন।‘‘তিনি বললেন : সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক পাপের কাজ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া’’। এ কথা বলার পর তিনি পিঠ হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন : ‘‘মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা’’। ‘‘তিনি এ কথাটি বারবার বলতে থাকলে আমরা মনে মনে ভাবলাম, হায় যদি তিনি নীরব হতেন।’’[1]

এ-হাদীসে যে তিনটি অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তন্মধ্যে পরিণতির দিক থেকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করা হচ্ছে সর্বাধিক মারাত্মক অপরাধ। যারা এ অপরাধ করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার পরিষ্কার কথা হচ্ছে- তিনি কস্মিনকালেও তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে দেখবেন না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ﴾ [النساء: ٤٨]

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে শরীক করা হলে তিনি কখনও তা ক্ষমা করেন না, (তবে) এর চেয়ে নিম্নমানের অপরাধ হলে তিনি যাকে ইচ্ছা (তা) ক্ষমা করেন।’’[2] উপর্যুক্ত আয়াতের মর্মের প্রতি লক্ষ্য করলে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ যে সব অপরাধ করে আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টিতে পরিণতির দিক থেকে তন্মধ্যে শির্কই হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। একটি শির্কমূলক অপরাধ একজন মুসলিমের জন্য পরিণতির দিক থেকে অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ায় দেশের মুসলিম জনগণকে এ জঘন্য অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবগত করানো একান্ত প্রয়োজন। আর এ- প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই আলোচ্য অধ্যায়কে মোট পাঁচটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা হয়েছে।

وما توفيقي إلا بالله

> 

[1]. আল-বুখারী, ‘আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ঈসমাঈল, আস-সহীহ; সম্পাদনা : ড. মুস্তফা আদীব আল-বাগা, (বৈরুত : দ্বার ইবনে কাছীর আল-ইয়ামামা : ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), কিতাবুস শাহাদাত, বাব নং ১০, হাদীস নং- ২৫১০, ২/৯৩৯ ; আল-ক্বুশাইরী, মুসলিম ইবন হাজ্জাজ, আস-সহীহ; সম্পাদনা : মুহাম্মদ ফুআদ ‘আব্দুল বাক্বী, (বৈরুত : দ্বার এহইয়াউত তুরাছিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), কিতাবুল ঈমান, বাবু বয়ানিল কাবাইর , ১/৯৩।

[2] . আল-কুরআন, সূরা আন-নিসা : ৪৮।


শির্ক শব্দের আভিধানিক অর্থ :

ইবন মানযুর বলেছেন : ‘আশ-শির্কাতু’ ও ‘আশ-শারকাতু’ (الشرْكَةُ وَ الشَّرْكَةُ) সমার্থবোথক দু’টি শব্দ। যার অর্থ : দু’শরীকের সংমিশ্রণ। তিনি আরো বলেন : ‘ইশতারাকনা’ (اشْتَرَكْنا) আমরা শরীক হলাম শব্দের অর্থ : ‘তাশারাকনা’ (تَشَارَكْنَا) আমরা পরস্পর শরীক হলাম। দু’জন শরীক হলো আর পরস্পর শরীক হলো বা একে অপরের সাথে শরীক হলো কিংবা শরীক হওয়া, এ-সব শব্দের অর্থ ‘আল-মুশারিক’ (الْمُشَارِكُ) বা অংশীদার। ‘আশ-শির্কু’ (الشِّرْكُ) শরীক করাও শরীক হওয়ার মতই। এর বহু বচন হলো : ‘আশরাক’ ও ‘শুরাকা-উ’ ‘(أَشْرَاكٌ وَ شُرَكَاءٌ) অর্থাৎ : সকল শরীকান বা অংশীদার।

তিনি আরো বলেন : ‘আশ-শির্কু’ (اَلشِّرْكُ) শব্দটি ‘আল-হিস্সাতু’ (اَلْحِصَّةُ) : অংশের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : [ مَنْ أَعْتَقَ شِرْكاً لَهُ فِيْ عَبْدٍ...]’’- ‘‘যে তার কোন ক্রীতদাসের অংশকে মুক্ত করে দিল...।’’[1] বলা হয়ে থাকে ‘‘طَرِيْقٌ مُشْتَرَكٌ’’ অর্থাৎ সম্মিলিত রাস্তা, যা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার রয়েছে। ‘আশরাকা বিল্লাহি’ (أِشْرَكَ بِاللهِ) সে আল্লাহর সাথে শরীক করলো, অর্থাৎ আল্লাহর রাজত্বে কাউকে তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করলো।[2] (নাউযু বিল্লাহি)

আল-মুনজিদ নামক অভিধানে বলা হয়েছে : (أَشْرَكَ فِيْ أَمْرِهِ) অর্থাৎ- তার কাজে সে (অপর কাউকে) শরীক করে নিয়েছে। (أَشْرَكَ بِاللهِ) অর্থাৎ- সে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে। আর যে তা করলো সে মুশরিক হয়ে গেল।[3]

শেখ যাকারিয়্যা আলী ইউছুফ বলেন :

‘‘কোন ক্ষেত্রে ‘শারাকতুহু’ ও আশ-রাকতুহু’ (شَرَكْتُهُ وَ أَشْرَكْتُه) তখনই বলা হয় যখন সে ক্ষেত্রে আমি কারো ‘শরীক’ (شَرِيْكٌ) অংশীদার হয়ে গেলাম, ‘শা-রাকতুহু’ (شَارَكْتُهُ)শব্দটিও শরীক এর অর্থ প্রকাশ করে।‘আশরাকতুহু’ (أَشْرَكْتُهُ) শব্দের অর্থ: আমি তাকে শরীক করে নিলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَأَشۡرِكۡهُ فِيٓ أَمۡرِي ٣٢ [طه: ٣٢]

(হে আল্লাহ) ‘‘তুমি হারূনকে আমার নবুওতের অংশীদার করে দাও।’’[4]

তিনি আরো বলেন: ‘শির্ক’ শব্দমূলটি সংমিশ্রণ ও একত্রিকরণের অর্থ প্রকাশ করে। কোন বস্তুর অংশ বিশেষ যখন একজনের হবে, তখন এর অবশিষ্ট অংশ হবে অপর এক বা একাধিকজনের। আল্লাহর বাণী :

﴿أَمۡ لَهُمۡ شِرۡكٞ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ﴾ [فاطر: ٤٠]

‘‘তবে কি আকাশমণ্ডলীতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে’’[5] এ-আয়াতে বর্ণিত ‘শির্কুন’ শব্দের দ্বারা এ অংশীদারিত্বের অর্থই প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, একজন অংশীদার তার অপর অংশীদারের সাথে সংমিশ্রণকারী এবং তার অংশ অপরের অংশের সাথে মিলিত।

তিনি আরো বলেন : কোনো বস্তুতে একাধিক শরীক হলে সে বস্তুতে তাদের প্রত্যেকের অংশ সমান হওয়াটি অত্যাবশ্যক নয়, তাদের একের অংশ অপরের অংশের চেয়ে অধিক হওয়ার পথেও তা কোন অন্তরায় সৃষ্টি করে না, যেমন মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর রেসালতের ক্ষেত্রে স্বীয় ভাই হারূন আলাইহিস সালামকে তাঁর সাথে শরীক করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করলে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ قَالَ قَدۡ أُوتِيتَ سُؤۡلَكَ يَٰمُوسَىٰ ٣٦ [طه: ٣٦]

‘‘হে মূসা! তোমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা হলো।’’[6]

এ কথা বলে আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালাম-এর কামনা পূর্ণ করে থাকলেও রেসালতের ক্ষেত্রে হারূন আলাইহিস সালাম-কে সমান অংশীদার করে দেন নি; বরং সে ক্ষেত্রে হারূন আলাইহিস সালাম-এর অংশ মূসা আলাইহিস সালাম-এর অংশের চেয়ে কম ছিল।[7]উপর্যুক্ত বর্ণনার আলোকে আমাদের নিকট এ-কথা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ‘শির্ক’ শব্দমূলটি মূলগতভাবেই মিশ্রণ ও মিলনের অর্থ প্রকাশ করে থাকে এবং এ মৌলিক অর্থটি এর সকল রূপান্তরিত শব্দের মধ্যে নিহিত থাকে। আর দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকার অংশীদারিত্ব যেমন ইন্দ্রিয় অনুভূত বস্তুসমূহের মধ্যে হতে পারে[8], তেমনি তা কোন অর্থগত বা গুণগত[9] বস্তুতেও হতে পারে।

[1]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল এত্ক, বাব নং ৪, হাদীস নং ২৩৮৬, ২/৮৯২; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল এত্ক, হাদীস নং ১৫০১, ৩/১২৮৭।

[2]. ইবন মানযুর, লেছানুল ‘আরব; শব্দমূল :
الشِّرْكُ, (কুম:নাশরু আদাবিল হাওযাঃ সংস্করণ বিহীন, ১৮০৫হি.), ১০/৪৪৮-৪৫০।

[3]. অধ্যাপক আনতুয়ান না‘মাঃ ও গং, আল-মুনজিদ; (বৈরুতঃ দারুল মাশরিক, সংস্করণ ২১, ১৯৭২ খ্রি.), পৃ.৩৮৪।

[4] . আল-কুরআন, সূরা ত্বাহা : ৩২।

[5] . আল-কুরআন, সূরা আহকাফ : ৪।

[6] . আল-কুরআন, সূরা ত্বাহা : ৩৬।

[7]. যাকারিয়্যা আলী ইউছুফ, আল-ঈমান ওয়া আ-ছারুহু ওয়া আশশির্কু ওয়া মাযাহিরুহু; (কায়রো : মাকতাবাতুস সালাম আল- আলমিয়্যা : ২য় সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ৭৮।

[8]. যেমন দুই বা ততোধিক ব্যক্তির কোনো বাড়ী, জমি বা গাড়ীতে সমঅংশে বা বেশ-কমে অংশীদার হওয়া।

[9]. যেমন মানুষ এবং ঘোড়া প্রাণী হওয়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে অংশীদার এবং দু’টি ঘোড়া বাদামী বা লাল বর্ণের হওয়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে শরীক হতে পারে।

 

 শির্ক শব্দের পারিভাষিক অর্থ

ড. ইব্রাহীম আল-বুরাইকান শির্ক-এর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :

‘শির্ক’-এর দু’টি অর্থ রয়েছে :

এক. সাধারণ অর্থ, আর তা হচ্ছে- গায়রুল্লাহকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ করা। সমকক্ষ বলতে এখানে মুক্ত শরীকানা বুঝানো হয়ে থাকে, শরীকানায় আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের সমান হতে পারে অথবা আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহের অংশের চেয়ে অধিকও হতে পারে। তিনি আরো বলেন :

শির্কের উপর্যুক্ত সাধারণ অর্থের ভিত্তিতে শির্ক তিন প্রকার :

এক. আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ করা অথবা কোনো বৈশিষ্ট্যকে তিনি ব্যতীত অন্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা। যেমন সৃষ্টি, জীবিকা, জীবন ও মৃত্যু ইত্যাদির সম্পর্ক অন্যের সাথে করা।

দুই. আল্লাহর উলূহিয়্যাতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে কাউকে সমকক্ষ করা। যেমন : সালাত, সাওম, পশু উৎসর্গকরণ ও মানত ইত্যাদি অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা।

তৃতীয়. আল্লাহ তা‘আলার নামাবলী ও গুণাবলীতে শির্ক। এর সংজ্ঞা হচ্ছে- আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলীতে কোনো সৃষ্টিকে তাঁর সমকক্ষ করা।

শির্কের দ্বিতীয় অর্থ :

“আল্লাহর পাশাপাশি গায়রুল্লাহকে উপাস্য ও মান্যবর হিসেবে গ্রহণ করা। কুরআন, সুন্নাহ ও অগ্রবর্তী মনীষীগণের কথায় শির্ক শব্দটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা শির্কের দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।’’[1]

আক্বীদার বিভিন্ন কিতাবাদিতে শির্ক-এর যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, তা অনেকটা ড. ইব্রাহীম বুরাইকান কর্তৃক বর্ণিত উপর্যুক্ত সংজ্ঞারই অনুরূপ। উপর্যুক্ত এ সংজ্ঞার দ্বারা যদিও শির্ক’র পারিভাষিক অর্থ অনুধাবন করা যাচ্ছে, তবে আমরা যদি আরো পরিষ্কারভাবে এর সংজ্ঞা জানতে চাই, তা হলে শির্ককে তাওহীদ-এর সংজ্ঞার বিপরীতে দাঁড় করালে তা জানা যেতে পারে। কেননা, শির্ক শব্দটি তাওহীদ শব্দের অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। আর প্রবাদে রয়েছে ‘প্রত্যেক বস্তুকে তার বিপরীতধর্মী বস্তু দিয়ে পরিচয় করা যায়।’ তাই নিম্নে প্রথমে তাওহীদ-এর পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদান করা হলো এবং পরবর্তীতে এর সংজ্ঞা থেকেই শির্ক-এর সংজ্ঞা নিরূপণ করা হলো।

তাওহীদ শব্দের পারিভাষিক অর্থ :

‘তাওহীদ’ শব্দের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লামা জুরজানী বলেন: ‘‘তাওহীদ হলো: অন্তরে যা কিছুর কল্পনা বা ধারণা হয়, সে সব থেকে আল্লাহ তা‘আলার জাতসত্তাকে মুক্ত করা। তাওহীদ তিনটি বিষয়ের সমষ্টি : মহান আল্লাহকে রব হিসেবে জানা, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তাত্থেকে সকল শরীকদের অস্বীকার করা।’’[2]

আল্লামা জাযাইরী বলেন : তাওহীদ হলো : ‘‘মহান আল্লাহ তা‘আলার যাত, তাঁর গুণাবলী ও কর্মসমূহে কারো সমকক্ষ থাকা বা সে সকল ক্ষেত্রে তাঁর কোন সাদৃশ্য হওয়া এবং তাঁর রুবুবিয়্যাত ও উপাসনায় কারো অংশীদারিত্ব থাকা অস্বীকার করাকে তাওহীদ বলা হয়।’’[3]

তাওহীদের উপর্যুক্ত দু’টি সংজ্ঞাই অনেকটা সংক্ষিপ্ত হওয়াতে নিম্নে এর অপর একটি বিস্তারিত সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :

শেখ আব্দুল আযীয বলেন : ‘‘শর‘য়ী পরিভাষায় তাওহীদ হলো : বান্দা এ-কথা স্বীকার করবে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা হলেন সেই রব যিনি সকল সৃষ্টির জীবিকা প্রদান ও তাদের পরিচালনার কাজ এককভাবেই করে থাকেন, তিনি সকল সৃষ্টির উপাস্য, যাবতীয় উপাসনা ও আনুগত্য এককভাবে তাঁর জন্যেই নিবেদিত। আরো মনে করা যে, তিনি এককভাবে বড়ত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীর সার্বিক পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত।’’[4]

‘শির্ক’ যখন ‘তাওহীদ’ এর বিপরীত তখন শেখ ‘আব্দুল ‘আযীয কর্তৃক উপরে তাওহীদের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, সে হিসেবে এর বিপরীতে ‘শির্ক’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নিম্নরূপ দাঁড়ায় :

‘‘মহান আল্লাহকে সকল সৃষ্টির জীবন-জীবিকা দানকারী, তাদের ভাগ্যের ভাল-মন্দ ও সমগ্র জগত পবিচালনাকারী একক রব হিসেবে মনে না করা। বরং এক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টির ছোট বা বড় কোনো বস্তু যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, বা অলি ও দরবেশ নামের কোনো নেক মানুষকে এর কোনো কিছুর পূর্ণ বা আংশিক মালিক কিংবা শরীক, অথবা তা পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্যকারী বলে মনে করা। আল্লাহর সমীপে তাঁর পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কারো জন্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা অপর কোনো অলির শাফা‘আত উপকারী হয়ে থাকে বলে বিশ্বাস করা। উপর্যুক্ত রকমের ধারণার বশবর্তী হয়ে আল্লাহর একক উপাসনা ও আনুগত্য করার পরিবর্তে তাঁদের ওসীলা ও সুপারিশে উত্তম জীবন, জীবিকা ও সৌভাগ্য লাভ করার জন্য তাঁদের উপাসনা ও আনুগত্য করা। আল্লাহর জ্ঞান, তাঁর বড়ত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীর ক্ষেত্রে সৃষ্টি জগতের কাউকে তাঁর সমকক্ষ করা।’’

অন্য কথায় ‘‘এমন সব বিশ্বাস, কাজ, কথা ও অভ্যাসকে শির্ক বলা হয় যার দ্বারা বাহ্যত মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীতে অপর কারো অংশীদারিত্ব বা সমকক্ষতা প্রতীয়মান হয়।’’

অপর কথায় বলা যায় : ‘‘গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যে গায়রুল্লাহকে সমকক্ষ করাকে শির্ক বলা হয়।’’ শির্কের এ সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দু’টি কুরআনুল কারীম থেকে প্রমাণ করা যায়।

মহান আল্লাহ বলেন :

﴿ قَالُواْ وَهُمۡ فِيهَا يَخۡتَصِمُونَ ٩٦ تَٱللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٩٧ إِذۡ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٨ [الشعراء: ٩٦، ٩٨]

‘‘তারা (মুশরিকরা তাদের উপাস্য দেব-দেবীদের সাথে) জাহান্নামে কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়ে বলবে: আল্লাহর কসম! আমরা তথায় (পৃথিবীতে) প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব-পালনকর্তার সমতুল্য গণ্য করতাম।’’[5]

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা তাদের পাথর ও কাঠ ইত্যাদির মূর্তিসমূহকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নেয়ার কারণেই বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে মুশরিক হয়েছিল।শির্ক যখন আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত ও গুণাবলীর বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত, তখন সর্বাগ্রে আমাদেরকে এ তিনটি বিষয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে হবে কেননা; এতে আমাদের নিকট শির্কের সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ পরিষ্কার হয়ে উঠবে।

[1]. ড. ইব্রাহীম বুরাইকান, আল-মাদখালু লিদেরাসাতিল ‘আক্বীদাতিল ইসলামিয়্যাহ ‘আলা মাযহাবি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; (আল-খুবার : দ্বারুস সুন্নাহ লিন নসরি ওয়াত তাওযী‘, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ১২৫, ১২৬।

[2]. আল-জুরজানী, শরীফ আলী ইবন মুহাম্মদ, কিতাবুত তা‘রীফাত; (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ.৬৭।

[3].আল-জাযাইরী, আবু বকর জাবির, ‘আক্বীদাতুল মু‘মিন; (জেদ্দা : দারুস সুরুক, ৫ম সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), পৃ.৮৭।

[4].আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মদ আল-সলমান, আল-আসইলাতু ওয়াল আজইবাতিল উসূলিয়্যাতি আলাল ‘আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যাতি লি ইবনে তাইমিয়্যাহ; (প্রকাশ বিহীন, ২১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৩২।

[5]. আল-কুরআন, সূরা শু‘আরা : ৯৬-৯৮।

 


© Arefin Masuk. All rights reserved. Premium By FC Themes