Posts

জান্নাতেরআদ্যোপান্ত ll Jannater Sesh theke Suru ll Published by :dinislam.xyz

জান্নাত. জান্নাত শব্দের অর্থ হলঃ উদ্যান, বাগান, বাগিচা। ফারসী ভাষায় যাকে বেহেশত বলা হয়। মহান আল্লাহ মহাপ্রতিদান স্বরূপ যা নিজ অনুগত বান্দার মরণের

জান্নাত

জান্নাত শব্দের অর্থ হলঃ উদ্যান, বাগান, বাগিচা। ফারসী ভাষায় যাকে বেহেশত বলা হয়।

মহান আল্লাহ মহাপ্রতিদান স্বরূপ যা নিজ অনুগত বান্দার মরণের পর পরকালে প্রস্তুত রেখেছেন।

জান্নাত মানে শুধু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগানই নয়; বরং তাতে থাকবে বাসস্থান, অট্টালিকা এবং চরম সুখ-সামগ্রীর এমন সবকিছু, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। সেখানে এমন সুখ থাকবে, যাতে কোন দুঃখের লেশমাত্র থাকবে না। এমন নির্মল শান্তি থাকবে, যাতে কোন প্রকার অশান্তির মলিনতা নেই। এত সুখসম্পদ থাকবে, যার কাল্পনিক বর্ণনা দিতেও মানুষের মন অক্ষম।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, 'আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য (জান্নাতে) এমন জিনিস প্রস্তুত রেখেছি, যা কোন চক্ষু দর্শন। করেনি, কোন কর্ণ শ্রবণ করেনি এবং যার সম্পর্কে কোন মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পার---

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

যার অর্থ, “কেউই জানে না তার জন্য তার কৃতকর্মের বিনিময় স্বরূপ নয়ন-প্রীতিকর কি পুরস্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছে।” (সাজদাহঃ ১৭ আয়াত, বুখারী-মুসলিম)।

পার্থিব জগতেই কত বিলাসপ্রিয় ধনকুবেররা বিলাসবহুল বাগান ও বাড়ি বানিয়ে বসবাস করে, কত রকম সুখ-সরঞ্জাম ও বিলাসসামগ্রী ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু সেসব কিছু জান্নাতের তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ। যেহেতু জান্নাতের সুখ অনুপম, বেহেশতের শান্তি অতুল। যেহেতু “বেহেশতের একটি চাবুক পরিমাণ জায়গা পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থিত সবকিছু অপেক্ষা উত্তম।” (বুখারী ৩২৫০নং)। “জান্নাতে ধনুক পরিমাণ স্থান (দুনিয়ার) যেসব বস্তুর উপর সূর্য উদিত কিম্বা অস্তমিত হচ্ছে, সেসব বস্তুর চেয়েও উত্তম।” (বুখারী-মুসলিম)।

জান্নাতের সে সুখ-সামগ্রী দেখে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী মানুষটিও সমস্ত দুঃখের কথা ভুলে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে? সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু! আর জান্নাতীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাত্র একবার) চুবানোর পর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে? সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।” (মুসলিম)

আর সে কারণেই বেহেশতে স্থান লাভ করা এমন সৌভাগ্যের ব্যাপার, যার পর কোন সৌভাগ্য নেই। মহান আল্লাহর ভাষায় সেটাই মহা সফলতা। তিনি বলেন,

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۗ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۖ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ۗ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ

অর্থাৎ, জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর কিয়ামতের দিনই তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় প্রদান করা হবে। সুতরাং যাকে আগুন (দোযখ) থেকে দুরে রাখা হবে এবং (যে) বেহেশতে প্রবেশলাভ করবে, সেই হবে সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভােগ ব্যতীত কিছুই নয়। (আলে ইমরানঃ ১৮৫)

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থাৎ, আল্লাহ বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদেরকে এমন উদ্যানসমূহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, যেগুলাের নিম্নদেশে বইতে থাকবে নদীমালা, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আরও (প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) চিরস্থায়ী উদ্যানসমূহে (জান্নাতে আদনে) পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় (নিয়ামত)। এটাই হচ্ছে মহা সফলতা। (তাওবাহঃ ৭২)

وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থাৎ, যে আল্লাহ ও রসূলের অনুগত হয়ে চলবে, আল্লাহ তাকে বেহেস্তে স্থান দান করবেন; যার নীচে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এ মহা সাফল্য। (নিসাঃ ১৩)

 জান্নাত ও জাহান্নাম পূর্ব হতেই সৃষ্ট


আহলে সুন্নাহ অল-জামাআতের আক্বীদা এই যে, মহান সৃষ্টিকর্তা জান্নাত-জাহান্নাম আগেই সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার বাসিন্দা সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, জান্নাত-জাহান্নাম বর্তমানে প্রস্তুত রয়েছে। মহান আল্লাহ জান্নাত সম্বন্ধে বলেছেন,

وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ

অর্থাৎ, তোমরা প্রতিযোগিতা (ত্বরা) কর, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা এবং বেহেস্তের জন্য, যার প্রস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সমান, যা ধর্মভীরুদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩৩)

سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ

অর্থাৎ, তোমরা আগ্রণী হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততার মত, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণে বিশ্বাসীদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। (হাদীদঃ ২১)

আর জাহান্নাম সম্বন্ধে বলেছেন,

فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ ۖ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ

অর্থাৎ, যদি তোমরা (সূরা আনয়ন) না কর, এবং কখনই তা করতে পারবে না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে। (বাক্বারাহঃ ২৪)

وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ

অর্থাৎ, তোমরা সেই আগুনকে ভয় কর, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩১)

إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21) لِّلطَّاغِينَ مَآبًا (22)

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে---সীমালংঘনকারীদের প্রত্যাবর্তনস্থল রূপে। (নাবাঃ ২১–২২)

মহানবী (সাঃ) মিরাজের রাতে জান্নাত দর্শন করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ (13) عِندَ سِدْرَةِ الْمُنتَهَىٰ (14) عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ (15) إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَىٰ (16) مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ (17) لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَىٰ (18)

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার নিকট অবস্থিত (জান্নাতুল মাওয়া) বাসােদ্যান। যখন (বদরী) বৃক্ষটিকে, যা আচ্ছাদিত করার ছিল তা আচ্ছাদিত করল, তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। নিঃসন্দেহে সে তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিল। (নাজমঃ ১৩-১৮)।

বরং মহানবী (সাঃ) সে রাত্রে জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। (বুখারী-মুসলিম)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন মারা যায়, তখন সকালসন্ধ্যায় তার অবস্থানক্ষেত্র তাকে প্রদর্শন করা হয়। জান্নাতী হলে জান্নাতের এবং জাহান্নামী হলে জাহান্নামের। তাকে বলা হয়, এই হল তোমার থাকার জায়গা; যে পর্যন্ত না তোমাকে কিয়ামতে আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন।” (বুখারী ১৩৭৯, মুসলিম ২৮৬৬নং)

কবরের হিসাব ও প্রশ্ন সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, '...তখন আসমানের দিক হতে এক শব্দকারী শব্দ করেন, “আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য বেহেস্তের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে বেহেস্তের একটি লেবাস পরিয়ে দাও। এ ছাড়া তার জন্য বেহেস্তের দিকে একটি দরজা খুলে দাও।” তখন তার প্রতি বেহেস্তের সুখ-শান্তি ও বেহেস্তের খোশবু আসতে থাকে এবং তার জন্য তার কবর দৃষ্টিসীমা বরাবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। (আহমাদ ৪/২৮৭-২৮৮, আবু দাউদ ৪৭৫৩নং)।

একদা সূর্যগ্রহণের নামায পড়তে পড়তে মহানবী জান্নাত দর্শন করে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং জাহান্নাম দর্শন করে পিছু হটেছিলেন। (মুসলিম ৯০১নং)

তিনি বলেছেন, “আমি জান্নাতের দুয়ারে দাঁড়ালাম। অতঃপর দেখলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করেছে, তাদের অধিকাংশ গরীব-মিসকীন মানুষ। আর ধনবানদেরকে (তখনও হিসাবের জন্য আটকে রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে (অন্যান্য) জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর আমি জাহান্নামের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখলাম যে, যারা তাতে প্রবেশ করেছে, তাদের বেশীরভাগই নারীর দল।” (বুখারী ও মুসলিম)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে সাহাবীদের কোন কথা পৌছল। অতঃপর তিনি ভাষণ দিয়ে বললেন, “আমার নিকট জান্নাত ও জাহান্নাম পেশ করা হল। ফলে আমি আজকের মত ভাল ও মন্দ (একত্রে) কোন দিনই দেখিনি। যদি। তোমরা তা জানতে, যা আমি জানি, তাহলে কম হাসতে আর বেশি কাঁদতে।” সুতরাং সাহাবীদের জন্য সেদিনকার মত কঠিনতম দিন আর ছিল না। তাঁরা তাঁদের মাথা আবৃত করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। (বুখারী, মুসলিম)।

তিনি বলেছেন, “মুমিনদের রূহ জান্নাতের গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। পরিশেষে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দেহে ফিরিয়ে দেবেন।” (মালেক, নাসাঈ, বাইহাক্বী, সিঃ সহীহাহ ৯৯৫নং)

উক্ত হাদীস থেকে এ কথাও প্রমাণ হয় যে, কিয়ামত আসার পূর্বেও মুমিনদের রূহ জান্নাতে অবস্থান করে।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ যখন জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি করলেন, তখন জিব্রাঈলকে জান্নাতের দিকে পাঠিয়ে বললেন, 'যাও, জান্নাত এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, 'আপনার সম্মানের কসম! যে কেউ এর কথা শুনবে, সে এতে প্রবেশ করতে চাইবে। অতঃপর আল্লাহ জান্নাতকে কষ্টসাধ্য কর্মসমুহ দিয়ে ঘিরে দিতে আদেশ করলেন। তারপর আবার তাকে বললেন, যাও, জান্নাত এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, আপনার সম্মানের কসম! আমার আশঙ্কা হয় যে, কেউ তাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

অতঃপর আল্লাহ তাকে জাহান্নামের দিকে পাঠিয়ে বললেন, 'যাও, জাহান্নাম এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দেখলেন, তার আগুনের এক অংশ অপর অংশের উপর চেপে রয়েছে। অতঃপর তিনি ফিরে এসে বললেন, ‘আপনার সম্মানের কসম! যে কেউ এর কথা শুনবে, সে এতে প্রবেশ করতে চাইবে না। তারপর জাহান্নামকে মনোলােভা জিনিসসমূহ দিয়ে ঘিরে দিতে আদেশ করলেন এবং পুনরায় তাকে বললেন, 'যাও, জাহান্নাম এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, আপনার সম্মানের কসম! আমার আশঙ্কা হয় যে, কেউ পরিত্রাণ পাবে না, সবাই তাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সঃ তারগীব ৩৬৬৯নং)

হাদীসগ্রন্থগুলিতে এই শ্রেণীর আরো হাদীস রয়েছে, যাতে প্রমাণ হয় যে, জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

সুর ফুঁকার পরেও জান্নাত-জাহান্নাম অবশিষ্ট থাকবে, যেমন কিয়ামতে সূর্য থাকবে। অতএব এই সন্দেহে তা এখন সৃষ্ট নয় বলা যাবে না। বরং তা সৃষ্ট প্রস্তুত আছে। অবশ্য তার মধ্যে এমনও কিছু সাজ-সামগ্রী আছে, যা মহান আল্লাহ পরে সৃষ্টি করবেন।

 জান্নাতে প্রবেশ-সুখ


বিচার দিনে মুমিনরা মাত্র যোহর থেকে আসরের সময়কাল অবধি অপেক্ষা করবে। অতঃপর তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। সে কি আনন্দের দিন! যেদিন ফিরিশতাগণ তাদেরকে সম্মানের সাথে চির সুখময় বেহেশতের দিকে দলে দলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। কত কষ্ট ভোগা ও দেখার পর যখন জান্নাতের দরজায় পৌছবে, তখন ফিরিশতাগণ তাদেরকে সালাম ও স্বাগত জানাবেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ

অর্থাৎ, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং তার রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, 'তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তি), তোমরা সুখী হও এবং স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। (যুমার ও ৭৩)।

এই জান্নাত হল সেই মু'মিনদের পুরস্কার, যাদের বিশ্বাস, কথা ও কর্ম শুদ্ধ ছিল। যাদের অন্তর ছিল নির্মল, কথা ছিল উত্তম এবং কর্ম ছিল সৎ।

তবে বেহেশতে পৌঁছনোর আগে কিছু কষ্ট স্বীকার অবশ্যই করতে হবে। জান্নাতে যাওয়ার আগে জাহান্নামের ওপর স্থাপিত পুল আছে। সেই পুল পার হয়ে যেতে হবে জান্নাতে। পুল পার হওয়ার আগে মুমিনদের আপোসের দেনা-পাওনার প্রতিশোধ দেওয়া-নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। জান্নাত প্রবেশের জন্য আমাদের শেষ নবী আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, বরকতময় মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে একত্রিত করবেন। অতঃপর মুমিনগণ উঠে দাঁড়াবে এমনকি জান্নাতও তাদের নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে (যার কারণে তাদের জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে যাবে) সুতরাং তারা আদম (আঃ) এর নিকট আসবে অতঃপর বলবে হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) জান্নাত খুলে দেওয়ার আবেদন করুন। তিনি বলবেনঃ (তোমরা কি জানো না যে,) একমাত্র তোমাদের পিতার ভুলই তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করেছে? সুতরাং আমি এর যোগ্য নই। তোমরা আমার ছেলে ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট যাও। নবী (সাঃ) বলেন, অতঃপর তারা ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট যাবে। ইব্রাহিম (আঃ) বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। আমি আল্লাহর খলিল ছিলাম বটে কিন্তু এত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী নই। (অতএব) তোমরা মূসা (আঃ) এর নিকট যাও, যার সঙ্গে আল্লাহ সরাসরি কথা বলেছেন। ফলে তারা মূসার নিকট যাবে। কিন্তু তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। তোমরা আল্লাহর কালেমা ও তার রূহ ঈসার নিকট যাও। কিন্তু ঈসাও বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। অতঃপর তারা মোহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট আসবে। সুতরাং তিনি দাঁড়াবেন। অতঃপর তাকে (দরজা খোলার) অনুমতি দেয়া হবে। আর আমানত ও আত্মীয়তার বন্ধনকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

সুতরাং উভয়ে পুল সিরাতের দুদিকে ডানে ও বামে দাঁড়িয়ে যাবে। অতঃপর তোমাদের প্রথম দল বিদ্যুৎ গতিতে (অতি দ্রুতবেগে) পুল পার হয়ে যাবে। আমি (আবূ হুরায়রা) বললাম, আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! বিদ্যুতের মতো গতিতে পার হওয়ার অর্থ কি? তিনি বললেন, তোমরা কি দেখনি যে বিদ্যুৎ কিভাবে চোখের পলকে যায় আসে? অতঃপর (দ্বিতীয় দল) বাতাসের মতো গতিতে পার হবে। অতঃপর (পরবর্তী দল) পাখির মতো এবং মানুষের দৌড়ের মতো গতিতে। তাদেরকে নিজ নিজ আমল (সিরাত্ব) পার করাবে। আর তোমাদের নবী পুল সিরাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকবেন। তিনি বলবেন হে প্রভু! বাঁচাও, বাঁচাও! শেষ পর্যন্ত তাদের আমল সমূহ অক্ষম হয়ে পড়বে। এমনকি কোন ব্যক্তি পাছা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে (পুল-সিরাত) পার হবে। আর সিরাতের দুই পাশে আঁকড়া ঝুলে থাকবে। যাকে ধরার জন্য আদিষ্ট তাকে ধরে নেবে। অতঃপর (কিছু লোক) জখম হলেও বেঁচে যাবে। আর কিছু লোককে মুখ থুবড়ে জাহান্নামে ফেলা হবে। সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ আছে! নিশ্চয় জাহান্নামের গভীরতা ৭০ বছরের (দূরত্বের পথ)। (মুসলিম ১৯৫ নং)

 জান্নাতে সর্বপ্রথম প্রবেশকারী ব্যক্তি


জান্নাতে সর্বপ্রথম যিনি প্রবেশাধিকার লাভ করবেন, তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)। আর উম্মতসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে তারই উম্মত। এ হল মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত বিশেষ সম্মান।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমি সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করব। ...আমিই জান্নাতে প্রথম সুপারিশকারী হব।” (মুসলিম ১৯৭নং)

তিনি আরো বলেন, “আমি জান্নাতের নিকট এসে তার দরজা খুলতে বলব। দারোয়ান ফিরিশ্‌তা বলবেন, কে আপনি? আমি বলব, ‘মুহাম্মাদ। দারোয়ান বলবেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি, যেন আপনার পূর্বে অন্য কারো জন্য দরজা না খুলি।” (ঐ)

তিনি আরো বলেন, “আমরা (দুনিয়ায়) সর্বশেষে এসেছি, (আখেরাতে) সর্বপ্রথম কিয়ামতে উপস্থিত হব এবং আমরাই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করব।” (বুখারী ২৩৮, মুসলিম ৮৫৫নং)

এ উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম যে দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তা হল মুহাজিরীনের। (সিঃ সহীহাহ ৮৫৩নং)

 বিনা হিসাবে জান্নাত প্রবেশকারী দল

 শেয়ার ও অন্যান্য 

সর্বপ্রথম একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল। যে দলের ঈমান হবে সর্বোচ্চ শিখরে, তাক্বওয়া ও পরহেযগারী হবে সবার শীর্ষে এবং আমল হবে সবচেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জান্নাতের প্রথম প্রবেশকারী দলটির আকৃতি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের মত হবে। অতঃপর তাদের পরবর্তী দলটি আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জ্যোতির্ময় হবে। তারা (জান্নাতে) পেশাব করবে না, পায়খানা করবে না, থুথ ফেলবে না, নাক ঝাড়বে না। তাদের চিরুণী হবে স্বর্ণের। তাদের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধ কাঠ। তাদের স্ত্রী হবে আয়তলোচনা হুরগণ। তারা সকলেই একটি মানব কাঠামো, আদি পিতা আদমের আকৃতিতে হবে (যাদের উচ্চতা হবে) ষাট হাত পর্যন্ত।” (বুখারী-মুসলিম)

অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, “(জান্নাতে) তাদের পাত্র হবে স্বর্ণের, তাদের গায়ের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে, যাদের সৌন্দর্যের দরুন মাংস ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ থাকবে না। পারস্পরিক বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের সকলের অন্তর একটি অন্তরের মত হবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় তাসবীহ পাঠে রত থাকবে।” (ঐ)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আমার কাছে সকল উম্মত পেশ করা হল। আমি দেখলাম, কোন নবীর সাথে কতিপয় (৩ থেকে ৭ জন অনুসারী) লোক রয়েছে। কোন নবীর সাথে এক অথবা দুইজন লোক রয়েছে। কোন নবীকে দেখলাম তার সাথে কেউ নেই। ইতিমধ্যে বিরাট একটি জামাআত আমার সামনে পেশ করা হল। আমি মনে করলাম, এটিই আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল যে, এটি হল মূসা ও তাঁর উম্মতের জামাআত। কিন্তু আপনি অন্য দিগন্তে তাকান। অতঃপর তাকাতেই আরও একটি বিরাট জামাআত দেখতে পেলাম। আমাকে বলা হল যে, এটি হল আপনার উম্মত। আর তাদের সঙ্গে রয়েছে এমন ৭০ হাজার লোক, যারা বিনা হিসাব ও আযাবে বেহেস্ত প্রবেশ করবে।”

এ কথা বলে তিনি উঠে নিজ বাসায় প্রবেশ করলেন। এদিকে লোকেরা ঐ বেহেস্তী লোকদের ব্যাপারে বিভিন্ন আলোচনা শুরু করে দিল, যারা বিনা হিসাব ও আযাবে বেহেস্ত প্রবেশ করবে। কেউ কেউ বলল, ‘সম্ভবতঃ ঐ লোকেরা হল তারা, যারা আল্লাহর রসুল (সাঃ)-এর সাহাবা। কিছু লোক বলল, বরং সম্ভবতঃ ওরা হল তারা, যারা ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি। আরো অনেকে অনেক কিছু বলল। কিছু পরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাদের নিকট বের হয়ে এসে বললেন, “তোমরা কি ব্যাপারে আলোচনা করছ?” তারা ব্যাপার খুলে বললে তিনি বললেন, “ওরা হল তারা, যারা ঝাড়ফুঁক করে না, ঝাড়ফুঁক করায় না এবং কোন জিনিসকে অশুভ লক্ষণ মনে করে না, বরং তারা কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে।”

এ কথা শুনে উক্কাশাহ ইবনে মিহসান উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন যে, (হে আল্লাহর রসূল!) আপনি আমার জন্য দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে তাদের দলভুক্ত করে দেন!” তিনি বললেন, “তুমি তাদের মধ্যে একজন।” অতঃপর আর এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমার জন্যও দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে দেন। তিনি বললেন, “উক্কাশাহ (এ ব্যাপারে) তোমার অগ্রগমন করেছে।” (বুখারী-মুসলিম)

শুধু সত্তর হাজারই নয়, বরং ঐ সত্তর হাজারের প্রত্যেক হাজারের সাথে আরো ৭০ হাজার করে (অর্থাৎ ৪৯ লক্ষ) মুসলিম জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ লাভ করবে। (সঃ জামেঃ ৬৯৮৮নং)

অন্য বর্ণনা মতে ঐ সত্তর হাজারের প্রত্যেক ব্যাক্তির সাথে আরো সত্তর হাজার করে মুসলিম জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আহমাদ, সিঃ সহীহাহ ১৪৮৪নং) অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার ৪৯০ কোটি মানুষ বিনা হিসাব ও আযাবে জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে।

বরং প্রথমোক্ত বর্ণনা অনুসারে মহান আল্লাহ্‌র তিন অঞ্জলি অতিরিক্ত মুসলিমকে বিনা হিসাব ও আযাবে জান্নাত প্রবেশের অধিকার দেওয়া হবে। আর তার সংখ্যা কেবল তিনিই জানেন।

সম্ভবতঃ এই অগ্রগামীদের কথাই মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বলেছেন,

وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ (10) أُولَٰئِكَ الْمُقَرَّبُونَ (11) فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ (12) ثُلَّةٌ مِّنَ الْأَوَّلِينَ (13) وَقَلِيلٌ مِّنَ الْآخِرِينَ (14)

অর্থাৎ, আর অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তী। তারাই হবে নৈকট্যপ্রাপ্ত। তারা থাকবে সুখময় জান্নাতসমূহে। বহুসংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। (ওয়াকিয়াঃ ১০-১৪)

 ধনীদের তুলনায় গরীবরা আগে জান্নাতে যাবে

 গোনাহগার মু’মিনদের জান্নাত-প্রবেশ 

যেহেতু গরীবদের হিসাব কম; তাদের যাকাত নেই, হজ্জ নেই, মালের কোন হিসাব-নিকাশ নেই, তাই তারা নির্ঝঞ্জটে ধনীদের আগে আগেই জান্নাতে চলে যাবে। কিন্তু কতদিন আগে?

এক বর্ণনানুসারে ৪০ বছর আগে।

আল্লাহ্‌র রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ মুহাজিরদের দরিদ্রশ্রেনীর লোকেরা ধনশালীদের চেয়ে চল্লিশ বছর পূর্বে কিয়ামতের দিন জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম ২৯৭৯)

অন্য এক বর্ণনা মতে ৫০০ বছর আগে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ গরীব মুমিনরা ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী ২৩৫১ নং)

আসলে ধনী ও গরীবদের অবস্থা ভেদে সময়ের এই পার্থক্য হবে। সুতরাং যে গরীব সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যে ধনী সবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের উভয়ের সময়ের ব্যাবধান হবে ৫০০ বছর। আর যে গরীব সবশেষে জান্নাত প্রবেশ করবে এবং যে ধনী সর্বপ্রথম জান্নাত প্রবেশ করবে, তাদের উভয়ের সময়ের ব্যবধান হবে ৪০ বছর। আর আল্লাহই ভাল জানেন।


যে গোনাহগার মু’মিনরা তওবা না করেই মারা যাবে এবং আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবে, আল্লাহর ইচ্ছায় তারা জাহান্নামে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট শাস্তি ভোগ করবে। তাদেরকে সরাসরি জাহান্নামে দেওয়া হবে অথবা পুলসিরাত পার হওয়ার সময় পুল থেকে পিছল কেটে জাহান্নামে পতিত হবে। কেউ সুপারিশের ফলে, কেউ মহান আল্লাহর দয়ায়, আবার কেউ শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে তওহীদের ফযীলতে জান্নাতে স্থান লাভ করবে। কিন্তু তাদের মধ্যে জাহান্নামের ছাপ থেকে যাবে এবং জান্নাতে তারা জাহান্নামী’ বলে পরিচিত থাকবে। (বুখারী)

 জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি


জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি অথবা সর্বনিম্ন মানের জান্নাতীও কিন্তু ছোট জান্নাতের বা কম সুখের অধিকারী হবে না। এ ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “সর্বশেষে যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার সম্পর্কে অবশ্যই আমার জানা আছে। এক ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়ে (বা বুকে ভর দিয়ে) চলে জাহান্নাম থেকে বের হবে। তখন আল্লাহ আযযা অজাল্ল বলবেন, যাও জান্নাতে প্রবেশ কর। সুতরাং সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে সে ফিরে এসে বলবে, হে প্রভু! জান্নাত তো পরিপূর্ণ দেখলাম। আল্লাহ আযযা অজাল্ল বলবেন, 'যাও, জান্নাতে প্রবেশ কর। তখন সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত তো ভরে গেছে। তাই সে আবার ফিরে এসে বলবে, হে প্রভু! জান্নাত তো ভরতি দেখলাম। তখন আল্লাহ আযযা অজাল্ল বলবেন, যাও জান্নাতে প্রবেশ কর। তোমার জন্য থাকল পৃথিবীর সমতুল্য এবং তার দশগুণ (পরিমাণ বিশাল জান্নাত)! অথবা তোমার জন্য পৃথিবীর দশগুণ (পরিমাণ বিশাল জান্নাত রইল)! তখন সে বলবে, হে প্রভু! তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছ? অথবা আমার সাথে হাসি-মজাক করছ অথচ তুমি বাদশাহ (হাসি-ঠাট্টা তোমাকে শোভা দেয় না)।” বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এমনভাবে হাঁসতে দেখলাম যে, তাঁর চোয়ালের দাঁতগুলি প্রকাশিত হয়ে গেল। তিনি বললেন, “এ হল সর্বনিম্ন মানের জান্নাতী।” (বুখারী-মুসলিম)

এ জান্নাতী যখন জান্নাতের বাসস্থানে প্রবেশ করবে, তখন তার দু’টি হুরী স্ত্রী তার নিকট এসে বলবে, সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তোমাকে আমাদের জন্য এবং আমাদেরকে তোমার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। তখন সে বলবে, আমাকে যা দেওয়া হয়েছে, তা অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি। (মুসলিম)।

 কিয়ামতের পুর্বে যারা জান্নাতে প্রবেশ করেছেন


মানুষের ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে আদি পিতা আদম (আঃ) ও মাতা হাওয়াকে জান্নাতেই রাখা হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেন,

وَقُلْنَا يَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, আমি বললাম, হে আদম তুমি তোমার স্ত্রীসহ বেহেস্তে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না; হলে তোমরা অনাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (বাক্বারাহঃ ৩৫)

وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, আর বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর। কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (আরাফ ও ১৯)

কিন্তু শয়তানের প্রলোভন ও চক্রান্তে পড়ে আদম ও হাওয়া আল্লাহর অবাধ্য হয়ে গেলেন। ফলে তার শাস্তি স্বরূপ উভয়কে সেই সুখময় জান্নাত থেকে দুঃখময় এই মাটির ধরাধামে নামিয়ে দেওয়া হল। মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَىٰ آدَمَ مِن قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا (115) وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ (116) فَقُلْنَا يَا آدَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوٌّ لَّكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ الْجَنَّةِ فَتَشْقَىٰ (117) إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرَىٰ (118) وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ (119) فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَّا يَبْلَىٰ (120) فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ الْجَنَّةِ ۚ وَعَصَىٰ آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَىٰ (121) ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَىٰ (122) قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ (123)

অর্থাৎ, আমি তো ইতিপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দান করেছিলাম। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল; আমি তাকে দৃঢ়সংকল্প পাইনি। (স্মরণ কর,) যখন আমি ফিরিশ্তাগণকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদাহ কর’, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদাহ করল; সে অমান্য করল। অতঃপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত হতে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা কষ্ট পাবে। তোমার জন্য এটাই থাকল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং নগ্নও হবে না। সেখানে পিপাসার্ত হবে না এবং রোদ্র-ক্লিষ্টও হবে না। অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, 'হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষ ও অক্ষয় রাজ্যের কথা?’ অতঃপর তারা তা হতে ভক্ষণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা উদ্যানের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্য হল; ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন। সুতরাং তিনি তার তওবা কবুল করলেন ও তাকে পথ নির্দেশ করলেন। তিনি বললেন, তোমরা একে অপরের শত্রুরূপে একই সঙ্গে জান্নাত হতে নেমে যাও। পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের নির্দেশ এলে, যে আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না এবং দুঃখ-কষ্টও পাবে না। (ত্বাহাঃ ১১৫-১২৩)

আমাদের নবী (সাঃ) মিরাজের রাত্রে জান্নাত দর্শন করেছেন। এ ছাড়া শহীদগণ কিয়ামত হওয়ার পূর্বেই জান্নাতে বসবাস করেন। মাসরুক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ)-কে (وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ) (অর্থাৎ, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।) (আলে ইমরানঃ ১৬৯) এই আয়াত প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘শোন! আমরাও এ বিষয়ে (নবী (সাঃ)-কে) জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “তাদের (শহীদদের) আত্মাসমূহ সবুজ পক্ষীকুলের দেহ মধ্যে অবস্থান করবে। ঐ পক্ষীকুলের অবস্থানক্ষেত্র হল (আল্লাহর) আরশে ঝুলন্ত দীপাবলী। তারা বেহেশতে যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করে বেড়াবে। অতঃপর পুনরায় ঐ দীপাবলীতে ফিরে এসে আশ্রয় নেবে। একদা তাদের প্রতিপালক তাদের প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, 'তোমরা কি (আরো) কিছু কামনা কর? তারা বলল, 'আমরা আর কী কামনা করব? আমরা তো বেহেস্তে যেখানে খুশী সেখানে বিচরণ করে বেড়াচ্ছি!’ (আল্লাহ) অনুরূপভাবে তাদেরকে তিনবার প্রশ্ন করলেন। অতঃপর যখন তারা দেখল যে, কিছু না চাইলে তাদেরকে ছাড়াই হবে না, তখন তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা কামনা এই করি যে, আপনি আমাদের আত্মাসমূহকে আমাদের নিজ নিজ দেহে ফিরিয়ে দিন, যাতে আমরা আপনার রাহে দ্বিতীয়বার নিহত হয়ে আসতে পারি। অতঃপর আল্লাহ যখন দেখবেন যে, তাদের আর কোন প্রয়োজন (কামনা বা সাধ) নেই, তখন তাদেরকে স্ব-অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হবে।” (মুসলিম ১৮৮৭)।

জান্নাত চিরস্থায়ী জান্নাতীরাও চিরঞ্জীব


দুনিয়া ধ্বংস হয়ে পরকালের জীবন শুরু হলে, সে জীবন হবে অনন্ত কালের। অন্তহীন হবে জান্নাত, অন্তহীন হবে জান্নাতীরা। না জান্নাত ধ্বংস হবে, আর না জান্নাতীরা বৃদ্ধ ও মরণাপন্ন হবে। বরং তারা চিরতরের জন্য ইচ্ছাসুখে সেখানে বসবাস করবে। মহান আল্লাহ বলেন,

لَا يَذُوقُونَ فِيهَا الْمَوْتَ إِلَّا الْمَوْتَةَ الْأُولَىٰ ۖ وَوَقَاهُمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ

অর্থাৎ, (ইহকালে) প্রথম মৃত্যুর পর তারা সেখানে আর মৃত্যু আস্বাদন করবে না। আর তিনি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা করবেন। (দুখানঃ ৫৬)

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا (107) خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا (108)

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে ফিরদাউসের উদ্যান। সেথায় তারা স্থায়ী হবে; এর পরিবর্তে তারা অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়া কামনা করবে না। (কাহ্‌ফঃ ১০৭-১০৮)

إِنَّ هَٰذَا لَرِزْقُنَا مَا لَهُ مِن نَّفَادٍ

অর্থাৎ, নিশ্চয় এটি আমার (দেওয়া) রুযী; যার কোন শেষ নেই। (স্বাদঃ ৫৪)

مَّثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۖ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ أُكُلُهَا دَائِمٌ وَظِلُّهَا ۚ تِلْكَ عُقْبَى الَّذِينَ اتَّقَوا ۖ وَّعُقْبَى الْكَافِرِينَ النَّارُ

অর্থাৎ, সাবধানীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার বিবরণ এইরূপঃ ওর পাদদেশে নদী প্রবাহিত, ওর ফলমূলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী; যারা সাবধানী এটা তাদের পরিণাম। আর অবিশ্বাসীদের পরিণাম হল জাহান্নাম। (রা’দ ৩৫)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে, সে চিরসুখে থাকবে, সে কোন কষ্ট পাবে না, তার পরিচ্ছদ পুরাতন হবে না এবং তার যৌবনও শেষ হবে না।” (মুসলিম ২৮৩৬নং)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, জান্নাতীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, তখন একজন ঘােষণাকারী ঘােষণা করবে যে, তোমাদের জন্য এখন অনন্ত জীবন; তোমরা আর কখনো মরবে না। তোমাদের জন্য এখন চির সুস্বাস্থ্য; তোমরা আর কখনো অসুস্থ হবে না। তোমাদের জন্য এখন চির যৌবন; তোমরা আর কখনো বৃদ্ধ হবে না। তোমাদের জন্য এখন চির সুখ ও পরমানন্দ; তোমরা আর কখনো দুঃখ-কষ্ট পাবে না। (মুসলিম)।

এ ছাড়া হাদীসে এসেছে যে, মৃত্যুকে দুম্বার আকারে নিয়ে এসে যবেহ করা হবে এবং বলা হবে, হে জান্নাতীগণ! তোমরা চিরকাল বাস কর, আর কোন মৃত্যু নেই৷ হে জাহান্নামীগণ! তোমরা চিরকাল বাস কর, আর কোন মৃত্যু নেই।' (বুখারী-মুসলিম)

প্রকাশ থাকে যে,

فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ (106) خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۚ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ (107) وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ ۖ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ (108)

অর্থাৎ, অতএব যারা দুর্ভাগ্যবান, তারা তো হবে দোযখে; তাতে তাদের চীৎকারও আর্তনাদ হতে থাকবে। তারা অনন্তকাল সেখানে থাকবে, যতকাল আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে; যদি না তোমার প্রতিপালকের অন্য ইচ্ছা হয়। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন, তা সম্পাদনে সুনিপুণ। পক্ষান্তরে যারা সৌভাগ্যবান, তারা থাকবে বেহেস্তে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে, যতকাল আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে; যদি না তোমার প্রতিপালকের অন্য ইচ্ছা হয়। এ হবে অফুরন্ত অনুদান। (হূদঃ ১০৬-১০৮)

এই আয়াতসমূহ দ্বারা কিছু মানুষ এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে যে, জাহান্নামের আযাব কাফেরদের জন্যও চিরস্থায়ী নয়; বরং সাময়িক। অর্থাৎ, ততদিন থাকবে, যতদিন আকাশ ও পৃথিবী থাকবে। (তারপর শেষ হয়ে যাবে।) কিন্তু এই কথা ঠিক নয়। কারণ এখানে (مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ) কথাটি আরববাসীদের দৈনন্দিন কথাবার্তা ও পরিভাষা অনুযায়ী অবতীর্ণ হয়েছে। আরববাসীদের অভ্যাস ছিল যে, যখন তারা কোন বস্তুর চিরস্থায়িত্ব প্রমাণ করার উদ্দেশ্য হত, তখন তারা বলত, (هذا دائم دوام السموات والارض) “এই বস্তু আকাশ ও পৃথিবীর মত চিরস্থায়ী।” সেই পরিভাষাকে কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, যার অর্থ কাফের ও মুশরিকরা চিরকালব্যাপী জাহান্নামে থাকবে, যা কুরআন বিভিন্ন স্থানে, (خالدين فيها) শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছে। তার দ্বিতীয় এক অর্থ এও করা হয়েছে যে, আকাশ ও পৃথিবী থেকে উদ্দেশ্য হল ‘জিনস’ (শ্রেণী)। অর্থাৎ, ইহলৌকিক আকাশ ও পৃথিবী; যা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এ ছাড়া পারলৌকিক আকাশ ও পৃথিবী পৃথক হবে। যেমন কুরআনে তার পরিষ্কার বর্ণনা এসেছে (يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ) অর্থাৎ, যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশমন্ডলীও।” (ইব্রাহীম ৪৮) আর পারলৌকিক উক্ত আকাশ ও পৃথিবী, জান্নাত ও জাহান্নামের মত চিরস্থায়ী হবে। এই আয়াতে সেই পারলৌকিক আকাশ-পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে, ইহলৌকিক আকাশ-পৃথিবীর কথা নয়, যা ধ্বংস হয়ে যাবে। (ইবনে কাসীর) এই উভয় অর্থের যে কোন অর্থ নেওয়া হলে আয়াতের উদ্দেশ্য পরিস্ফুটিত হয়ে যাবে এবং উপস্থাপিত সমস্যা দূর হয়ে যাবে। ইমাম শওকানী (রঃ) এর আরো কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন, যা জ্ঞানীরা দেখতে পারেন। (ফাতহুল কাদীর)।

আয়াতে উল্লিখিত ব্যতিক্রমের কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে সব থেকে সঠিক অর্থ এই যে উক্ত ব্যতিক্রম তওহীদবাদী মুমিন পাপীদের জন্য। এই অর্থ অনুযায়ী এর পূর্ব আয়াতে (شقي) (দুর্ভাগ্যবান) শব্দটি ব্যাপক ধরতে হবে। অর্থাৎ কাফের ও পাপী মু’মিন উভয়কে বুঝাবে। আর (إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ) দ্বারা পাপী মু’মিনরা ব্যতিক্রম হয়ে যাবে। আর مَا شَاءَ তেمَا হরফটিمن এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যতিক্রমটিও পাপী মুমিনদের জন্য। অর্থাৎ, অন্য মু’মিনদের মত এই গোনাহগার মু’মিনরা প্রথম থেকে শেষ অবধি জান্নাতে থাকবে না। বরং শুরুতে কিছু দিন তাদেরকে জাহান্নামে থাকতে হবে, পরে আল্লাহর ইচ্ছায় আম্বিয়া ও মুমিনদের সুপারিশে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, যেমন সহীহ হাদীস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত।

(غَيْرَ مَجْذُوذٍ) এর অর্থ হল (غير مقطوع) অর্থাৎ, এমন অফুরন্ত অনুদান যা শেষ হওয়ার নয়। এই বাক্য দ্বারা এই কথা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, যে সকল পাপী মুমিনদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তারা ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং চিরস্থায়ী হবে এবং সকল জান্নাতীগণ আল্লাহ প্রদত্ত অনুদান ও তার নিয়ামত দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে, তা কোন কালে কখনও শেষ হবে না। (তফসীর আহসানুল বায়ান)

 জান্নাতের বিবরণ


জান্নাত এক অতুলনীয় শান্তিনিকেতন। জান্নাত মুমিনদের সুখের বাসা। ইচ্ছাসুখের নীড়। চক্ষুশীতলকারী আনন্দালয়। চির স্বাচ্ছন্দ্যের প্রমোদোদ্যান। নয়ন-জুড়ানো তার মাটি। মন মাতানো তার সৌরভ। হৃদয়ভলানো তার সৌন্দর্য।

জান্নাতের বিলাস-সামগ্রী বর্ণনাতীত, কল্পনাতীত। দুনিয়ার কোন সামগ্রী তার উদাহরণ ও উপমা হতে পারে না। মানুষ যত উচ্চ মানেরই সুখ-সামগ্রী আবিষ্কার করুক না কেন, জান্নাতের সুখ-সামগ্রীর সাথে কোন তুলনাই হবে না। জান্নাতের আলো, সুগন্ধি, অট্টালিকা, নদী-নহর, বৃক্ষ-ফল, খাদ্যপানীয়, সুন্দরী স্ত্রী, লেবাস-পোশাক ইত্যাদি সবকিছুই নজীরবিহীন।

জান্নাতের বিবরণ দিতে গিয়ে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “(তার অট্টালিকার) একটি ইট সােনার, একটি ইট চাদির, তার মাঝে সংযোজক হল তীব্র সুগন্ধময় কস্তুরী। তার পাথর-কাঁকর হল মণি-মুক্তা। তার মাটি হল জাফরান। যে তাতে প্রবেশ করবে, সে সুখী হবে এবং কোন কষ্ট পাবে না। চিরস্থায়ী হবে, মৃত্যুবরণ করবে না। তার লেবাস-পোশাক পুরাতন হবে না। তার যৌবন নষ্ট হবে না।” (আহমাদ, তিরমিযী, দারেমী)

মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَإِذَا رَأَيْتَ ثَمَّ رَأَيْتَ نَعِيمًا وَمُلْكًا كَبِيرًا

অর্থাৎ, তুমি দেখলে সেখানে দেখতে পাবে ভোগ-বিলাসের উপকরণ এবং বিশাল রাজ্য। (দাহরঃ ২০)

এ ছাড়া মহান আল্লাহ যা গুপ্ত রেখেছেন, তা মানুষের কল্পনার বাইরে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, 'আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য এমন জিনিস প্রস্তুত রেখেছি, যা কোন চক্ষ দর্শন করেনি, কোন কর্ণ শ্রবণ করেনি এবং যার সম্পর্কে কোন মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পার; যার অর্থ, “কেউই জানে না তার জন্য তার কতকর্মের বিনিময় স্বরূপ নয়ন-প্রীতিকর কি পুরস্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছে।” (সাজদাহঃ ১৭, বুখারী-মুসলিম)

 জান্নাতের দরজাসমূহ


জান্নাতে বিভিন্ন দরজা আছে। যে দরজা দিয়ে মুমিনগণ প্রবেশ করবে এবং প্রবেশ করবে ফিরিশতাগণও। মহান আল্লাহ বলেন,

جَنَّاتِ عَدْنٍ مُّفَتَّحَةً لَّهُمُ الْأَبْوَابُ

অর্থাৎ, চিরস্থায়ী জান্নাত, যার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে তাদের জন্য। (স্বাদঃ ৫০)

جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ ۖ وَالْمَلَائِكَةُ يَدْخُلُونَ عَلَيْهِم مِّن كُلِّ بَابٍ (23) سَلَامٌ عَلَيْكُم بِمَا صَبَرْتُمْ ۚ فَنِعْمَ عُقْبَى الدَّارِ (24)

অর্থাৎ, চিরস্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতামাতা, পতিপত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও। আর ফিরিশতাগণ তাদের কাছে প্রবেশ করবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। (তারা বলবে,) 'তোমরা ধৈর্যধারণ করেছ বলে তোমাদের প্রতি শান্তি! কতই না ভাল এই পরিণাম।’ (রা’দঃ ২৩-২৪)

মু'মিনগণ যখন জান্নাতের কাছে পৌছবে, তখন সেই দরজাসমূহ খোলা হবে। ফিরিশতাগণ তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ

অর্থাৎ, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং তার রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তি), তোমরা সুখী হও এবং স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। (যুমারঃ ৭৩)

মহানবী (সাঃ) জানিয়েছেন যে, জান্নাতের দরজাসমূহ প্রত্যেক বছর রমযান মাসে খুলে দেওয়া হয়। নবী (সাঃ) বলেছেন, মাহে রমযানের আগমন ঘটলে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী ও মুসলিম)

 জান্নাতের দরজা আটটি


মহানবী (সাঃ) বলেছেন, পরিপূর্ণরূপে ওযু করে যে ব্যক্তি এই দুআ বলবে, ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহদাহু লা শারীকা লাহ, অ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসুলুহ। তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে, যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা তাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জান্নাতের (আটটি দরজার) মধ্যে এমন একটি দরজা আছে, যার নাম হল ‘রাইয়ান’; সেখান দিয়ে কেবল রোযাদারগণই কিয়ামতের দিনে প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউ সেদিক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘােষণা করা হবে রোযাদাররা কোথায়? তখন তারা দন্ডায়মান হবে। (ঐ দরজা দিয়ে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে) তারপর যখন তাদের সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করবে, তখন দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর সেখান দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)

তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জোড়া বস্তু ব্যয় করে, তাকে জান্নাতের দরজাসমূহ থেকে ডাকা হবে, হে আল্লাহর বান্দা! এ দরজাটি উত্তম (এদিকে এস)। সুতরাং যে নামাযীদের দলভুক্ত হবে, তাকে নামাযের দরজা থেকে ডাক দেওয়া হবে। আর যে মুজাহিদদের দলভুক্ত হবে তাকে জিহাদের দরজা থেকে ডাকা হবে। যে রোযাদারদের দলভুক্ত হবে, তাকে ‘রাইয়ান’ নামক দরজা থেকে আহবান করা হবে। আর দাতাকে দানের দরজা থেকে ডাকা হবে।” এ সব শুনে আবু বাকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হােক, যাকে ডাকা হবে তার ঐ সকল দরজার তো কোন প্রয়োজন নেই। (কেননা মুখ্য উদ্দেশ্য হল, কোনভাবে জান্নাতে প্রবেশ করা।) কিন্তু এমন কেউ হবে কি, যাকে উক্ত সকল দরজাসমূহ থেকে ডাকা হবে? তিনি বললেন, “হ্যাঁ। আর আশা করি, তুমি তাদের দলভুক্ত হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)।

বিনা হিসাবের খাস লোকেরা জান্নাতের ডান দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। জান্নাতের দরজার প্রস্থও অনেক। হাদীসে এসেছে, কিয়ামতে সুপারিশের সময় মহান আল্লাহ বলবেন, “হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মতের মধ্যে যাদের কোন হিসাব-নিকাশ হবে না, তাদেরকে ডান দিকের দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাও। এই দরজা ছাড়া তারা অন্য সব দরজাতেও সকল মানুষের শরীক।”

অতঃপর নবী (সাঃ) বলেন, “যার হাতে আমার প্রাণ আছে, তাঁর কসম! জান্নাতের একটি দরজার প্রশস্ততা হচ্ছে মক্কা ও (বাহরাইনের) হাজারের মধ্যবর্তী দূরত্ব অথবা মক্কা ও (সিরিয়ার) বুসরার মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। {বুখারী-মুসলিম)।

এক বর্ণনায় দরজার দুই বাজুর মধ্যে ব্যবধানের দূরত্ব বলা হয়েছে চল্লিশ বছরের পথ। জান্নাত প্রবেশকালে তা ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। (মুসলিম, আহমাদ) আর আল্লাহই ভাল জানেন।

 আটটি জান্নাতের নাম


কেউ কেউ আটটি জান্নাতের নাম উল্লেখ করলেও আসলে সে নামগুলি সকল জান্নাতেরই গুণবাচক নাম। অবশ্য কোন কোন জান্নাতের নাম স্পষ্টতঃ উল্লেখ হয়েছে। যার বিবরণ নিম্নরূপঃ

ফিরদাউসঃ

এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا (107) خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا (108)

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, তাদের অভ্যর্থনার জন্য আছে ফিরদাউসের উদ্যান। সেথায় তারা স্থায়ী হবে; এর পরিবর্তে তারা অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়া কামনা করবে না। (কাহ্‌ফঃ ১০৭-১০৮)।

الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থাৎ, অবশ্যই বিশ্বাসিগণ সফলকাম হয়েছে। যারা ... তারাই হবে উত্তরাধিকারী। উত্তরাধিকারী হবে ফিরদাউসের; যাতে তারা চিরস্থায়ী হবে। (মু'মিনূনঃ ১-১১)।

আনাস (রাঃ) বলেন, উম্মে রুবাইয়ে’ বিন্তে বারা’ যিনি হারেষাহ ইবনে সূরাকাহর মা, তিনি নবী (সাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে হারেষাহ সম্পর্কে কিছু বলবেন না? সে বদরের দিনে খুন হয়েছিল। যদি সে জান্নাতী হয়, তাহলে ধৈর্য ধারণ করব, অন্যথা তার জন্য মন ভরে অত্যাধিক কান্না করব।' তিনি বললেন, “হে হারেষার মা! জান্নাতের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের জান্নাত আছে। আর তোমার ছেলে সর্বোচ্চ ফিরদাউস (জান্নাতে) পৌছে গেছে।” (বুখারী)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই জান্নাতে একশ’টি দরজা (মর্যাদা) রয়েছে, যা আল্লাহ তার পথে জিহাদকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন; দুটি দরজার মধ্যবর্তী ব্যবধান আসমান ও জমিনের মত। সুতরাং তোমরা (জান্নাত) চাইলে ফিরদাউস’ চেয়ো। কারণ তা হল জান্নাতের মধ্যভাগ ও জান্নাতের উপরিভাগ, আর তার উপরে রয়েছে রহমানের আরশ।” (বুখারী ২৭৯০ নং)

আদ্‌নঃ

‘আদন’ মানে চিরস্থায়ী। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ لَهُمْ فِيهَا مَا يَشَاءُونَ ۚ كَذَٰلِكَ يَجْزِي اللَّهُ الْمُتَّقِينَ

অর্থাৎ, ওটা স্থায়ী জান্নাত যাতে তারা প্রবেশ করবে; ওর নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; তারা যা কিছু কামনা করবে তাতে তাদের জন্য তাই থাকবে; এভাবেই আল্লাহ সাবধানীদেরকে পুরস্কৃত করেন। (নাহলঃ ৩১)

أُولَٰئِكَ لَهُمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِن ذَهَبٍ وَيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِّن سُندُسٍ وَإِسْتَبْرَقٍ مُّتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ ۚ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا

অর্থাৎ, তাদেরই জন্য আছে স্থায়ী জান্নাত; যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেথায় তাদেরকে স্বর্ণ-কঙ্কণে অলঙ্কৃত করা হবে, তারা পরিধান করবে সুক্ষ ও স্থূল রেশমের সবুজ বস্ত্র ও সমাসীন হবে সুসজ্জিত আসনে; কত সুন্দর সে পুরস্কার ও কত উত্তম সে আশ্রয়স্থল। (কাহফঃ ৩১)

جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِن ذَهَبٍ وَلُؤْلُؤًا ۖ وَلِبَاسُهُمْ فِيهَا حَرِيرٌ

অর্থাৎ, তারা প্রবেশ করবে স্থায়ী জান্নাতে, যেখানে তাদের স্বর্ণ-নির্মিত কঙ্কণ ও মুক্তা দ্বারা অলংকৃত করা হবে এবং যেখানে তাদের পোশাকপরিচ্ছদ হবে রেশমের। (ফাত্বিরঃ ৩৩)

جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدَ الرَّحْمَٰنُ عِبَادَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّهُ كَانَ وَعْدُهُ مَأْتِيًّا

অর্থাৎ, সেই স্থায়ী জান্নাত, যার প্রতিশ্রুতি পরম দয়াময় নিজ দাসদেরকে অদৃশ্যভাবে দিয়েছেন; নিশ্চয় তার প্রতিশ্রুত বিষয় অবশ্যম্ভাবী। (মারয়ামঃ ৬১)

এ ছাড়া আরো বহু আয়াতে এ জান্নাতের কথা উল্লিখিত হয়েছে।

মহানবী (সাঃ) স্বপ্নে আদ্‌ন জান্নাত দর্শন করেছেন। (বুখারী)

তিনি বলেছেন, “দু’টি জান্নাত চাদির, তার পাত্র ও সবকিছু চাদির। দু’টি জান্নাত সােনার, তার পাত্র ও সবকিছু সােনার। আদ্‌ন জান্নাতে (জান্নাতী) লোকেদের দীদার ও তাদের প্রতিপালকের মাঝে কেবল তার চেহারার উপর গৌরবের চাদর থাকবে।” (বুখারী-মুসলিম)

খুলদঃ

খুলদ’ মানেও চিরস্থায়ী। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

قُلْ أَذَٰلِكَ خَيْرٌ أَمْ جَنَّةُ الْخُلْدِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۚ كَانَتْ لَهُمْ جَزَاءً وَمَصِيرًا

অর্থাৎ, ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর, এটিই শ্রেয়, না স্থায়ী বেহেশ্ত; যার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সাবধানীদেরকে?’ এটিই তো তাদের প্রতিদান ও প্রত্যাবর্তনস্থল। (ফুরক্বান : ১৫)

সাহাবী ইবনে মাসউদ দুআয় বলেছিলেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ إِيمَانًا لا يَرْتَدُّ , وَنَعِيمًا لا يَنْفَدُ , وَمُرَافَقَةَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي أَعْلَى غُرَفِ جَنَّةِ الْخُلْدِ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অটল ঈমান চাই, অফুরন্ত নেয়ামত চাই এবং আদন জান্নাতের সবার উপরে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সঙ্গ চাই। (সিঃ সহীহাহ ২৩০ ১নং)।

নাঈমঃ

নাঈম’ মানে সম্পদশালী, সুখময়। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُم بِإِيمَانِهِمْ ۖ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস করেছে এবং ভাল কাজ করেছে তাদের প্রতিপালক তাদের বিশ্বাসের কারণে তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন, শান্তির উদ্যানসমূহে তাদের (বাসস্থানের) তলদেশ দিয়ে নদীমালা প্রবাহিত থাকবে। (ইউনুসঃ ৯)

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتُ النَّعِيمِ

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য আছে সুখের উদ্যানরাজি। (লুকমানঃ ৮)

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّاتِ النَّعِيمِ

অর্থাৎ, আল্লাহভীরুদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই ভোগ-বিলাসপূর্ণ জান্নাত রয়েছে। (ক্বালামঃ ৩৪)

ইব্রাহীম (আঃ) এই জান্নাত চেয়ে দুআ করে বলেছিলেন,

وَاجْعَلْنِي مِن وَرَثَةِ جَنَّةِ النَّعِيمِ

অর্থাৎ, আমাকে সুখকর (নাঈম) জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। (শুআরাঃ ৮৫)

মা’ওয়াঃ

‘মা’ওয়া মানে ঠিকানা। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَىٰ نُزُلًا بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, যারা বিশ্বাস করে সৎকাজ করে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তাদের আপ্যায়নের জন্য জান্নাত হবে তাদের বাসস্থান। (সাজদাহঃ ১৯)

وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ (13) عِندَ سِدْرَةِ الْمُنتَهَىٰ (14) عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ (15)

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার নিকট অবস্থিত (জান্নাতুল মাওয়া) বাসােদ্যান। (নাজমঃ ১৩-১৫)

দারুস সালামঃ

দারুস সালাম’ মানে শান্তিনিকেতন। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

لَهُمْ دَارُ السَّلَامِ عِندَ رَبِّهِمْ ۖ وَهُوَ وَلِيُّهُم بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য রয়েছে শান্তির আলয় এবং তারা যা করত, তার কারণে তিনি হবেন তাদের অভিভাবক। (আনআমঃ ১২৭)।

وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَىٰ دَارِ السَّلَامِ وَيَهْدِي مَن يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

অর্থাৎ, আল্লাহ (মানুষ)-কে শান্তির আবাসের দিকে আহবান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করেন। (ইউনুসঃ ২৫)।

দারুল মুক্বামাহঃ

দারুল মুক্বামাহ’ মানে স্থায়ী। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

الَّذِي أَحَلَّنَا دَارَ الْمُقَامَةِ مِن فَضْلِهِ لَا يَمَسُّنَا فِيهَا نَصَبٌ وَلَا يَمَسُّنَا فِيهَا لُغُوبٌ

অর্থাৎ, যিনি নিজ অনুগ্রহে, আমাদেরকে স্থায়ী আবাস দান করেছেন; যেখানে আমাদেরকে কোন প্রকার ক্লেশ স্পর্শ করে না এবং স্পর্শ করে না। কোন প্রকার ক্লান্তি।' (ফাত্বিরঃ ৩৫)

রাইয়ানঃ

‘রাইয়ান’ মানে তৃষ্ণাহীন। তৃষ্ণা ও পিপাসায় যারা কষ্ট পেয়েছে, তাদেরকে এই জান্নাত দেওয়া হবে। এ জান্নাত সম্বন্ধে নবী (সাঃ) বলেন, জান্নাতের এক প্রবেশদ্বার রয়েছে, যার নাম ‘রাইয়ান। কিয়ামতের দিন ঐ দ্বার দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউই ঐ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে না। রোযাদারগণ প্রবিষ্ট হয়ে গেলে দ্বার রুদ্ধ করা হবে। ফলে সে দ্বার দিয়ে আর কেউই প্রবেশ করবে না।” (বুখারী ১৮৯৬ নং, মুসলিম ১১৫২ নং, নাসাঈ, তিরমিযী)।

আদ-দারুল আ-খিরাহঃ

‘আদ-দারুল আ-খিরাহ’ মানে পরকালের আবাস। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ ۖ وَلَلدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِّلَّذِينَ يَتَّقُونَ ۗ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

অর্থাৎ, আর পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক বই আর কিছুই নয় এবং যারা সাবধানতা অবলম্বন করে, তাদের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেয়, তোমরা কি (তা) অনুধাবন কর না? (আনআমঃ ৩২)

تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا ۚ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ

অর্থাৎ, এ পরলোকের আবাস; যা আমি নির্ধারিত করি তাদেরই জন্য যারা এ পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। সাবধানীদের জন্য শুভ পরিণাম। (কাসাসঃ ৮৩)

দারুল হায়াওয়ানঃ

দারুল হায়াওয়ান’ মানে চিরজীবনের ঘর। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ۚ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, এ পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। আর পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন; যদি ওরা জানত। (আনকাবুতঃ ৬৪)

দারুল ক্বারারঃ

‘দারুল ক্বারার মানে স্থায়ী-গৃহ। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

يَا قَوْمِ إِنَّمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ

অর্থাৎ, হে আমার সম্প্রদায়! এ পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু। আর নিশ্চয় পরকাল হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস। (মু’মিনঃ ৩৯)

আল-মাকামুল আমীন

‘আল-মাক্বামুল আমীন’ মানে নিরাপদ স্থান। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي مَقَامٍ أَمِينٍ

অর্থাৎ, নিশ্চয় সাবধানীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে। (দুখান : ৫১)

মাক্বআদু স্বিদক্বঃ

‘মাক্বআদু স্বিদক মানে যথাযোগ্য আসন। এ জান্নাত সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেন,

فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِندَ مَلِيكٍ مُّقْتَدِرٍ

অর্থাৎ, সাবধানীরা থাকবে জান্নাতে ও নহরে। যথাযোগ্য আসনে, সার্বভৌমক্ষমতার অধিকারী সম্রাটের সান্নিধ্যে। (ক্বামারঃ ৫৫)

তুবাঃ

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “ঐ বান্দার জন্য ‘তুবা’ যে আল্লাহর পথে নিজের ঘােড়ার লাগাম ধরে প্রস্তুত আছে। যার মাথার কেশ আলুথালু, যার পদযুগল ধূলিমলিন। তাকে পাহারার কাজে নিযুক্ত করলে, পাহারার কাজে নিযুক্ত থাকে। আর তাকে সৈন্যদলের পশ্চাতে (দেখাশোনার কাজে) নিয়োজিত করলে, সৈন্যদলের পশ্চাতে থাকে। যদি সে কারো সাক্ষাতের অনুমতি চায়, তাহলে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না এবং কারো জন্য সুপারিশ করলে, তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না।” (বুখারী ২৮৮৭, মিশকাত ৫ ১৬ ১নং)

জ্ঞাতব্য যে, ‘তুবা’ জান্নাতের একটি গাছের নামও বলা হয়েছে। অথবা তার অর্থ হল, আনন্দ, বা কল্যাণময় জীবন। (দ্রঃ মিরআতুল মাফাতীহ ইত্যাদি)

 জান্নাতের বিভিন্ন স্তর বা শ্রেণীবিভাগ


জান্নাতের মাঝে বিভিন্ন স্তর আছে, বিভিন্ন শ্রেণী-বিভাগ আছে। সমস্ত জান্নাত সমান নয়, সকল জান্নাতীও সমশ্রেণীর নয়। জান্নাতীরা নিজ নিজ তাক্বওয়া ও আমল অনুযায়ী মান ও শ্রেণী লাভ করবে। বিভিন্ন জান্নাতীর দর্জাও ভিন্নতর হবে। উচ্চ মানের মুমিনরা উচ্চ শ্রেণীর দর্জা পাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَن يَأْتِهِ مُؤْمِنًا قَدْ عَمِلَ الصَّالِحَاتِ فَأُولَٰئِكَ لَهُمُ الدَّرَجَاتُ الْعُلَىٰ

অর্থাৎ, আর যারা তাঁর নিকট বিশ্বাসী হয়ে ও সৎকর্ম করে উপস্থিত হবে, তাদের জন্য আছে সমুচ্চ মর্যাদাসমূহ। (ত্বাহাঃ ৭৫)।

ইহকালে যেমন সকল মুমিনগণ একই স্তরের নয়, পরকালেও সবাই এক স্তরের হবে না। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

مَّن كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَّدْحُورًا (18) وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا (19) كُلًّا نُّمِدُّ هَٰؤُلَاءِ وَهَٰؤُلَاءِ مِنْ عَطَاءِ رَبِّكَ ۚ وَمَا كَانَ عَطَاءُ رَبِّكَ مَحْظُورًا (20) انظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۚ وَلَلْآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلًا (21)

অর্থাৎ, কেউ পার্থিব সুখ-সম্ভােগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি, পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি; সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও অনুগ্রহ হতে দুরীকৃত অবস্থায়। যারা বিশ্বাসী হয়ে পরলোক কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে, তাদেরই চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে। তোমার প্রতিপালক তার দান দ্বারা এদের ও ওদের (পরলোককামী ও ইহলোককামী উভয়কে) সাহায্য করেন এবং তোমার প্রতিপালকের দান অবারিত। লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের এক দলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। আর নিশ্চয়ই পরকাল মর্যাদায় বৃহত্তর ও মাহাত্মেও শ্রেষ্ঠতর। (বানী ইস্রাঈলঃ ১৮-২১)

অবশ্যই নবী, সাহাবী, শহীদ, ওলী, পরহেযগার ও গোনাহগার সকলেই সমান নয়। যেমন নবীগণও মর্যাদায় সকলে এক সমান নন। আল্লাহ বলেন,

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ

অর্থাৎ, এ রসূলগণ, তাদের মধ্যে কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। (বাক্বারাহঃ ২৫৩)

وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِمَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۗ وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّينَ عَلَىٰ بَعْضٍ ۖ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا

অর্থাৎ, যারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আছে, তাদেরকে তোমার প্রতিপালক ভালভাবে জানেন। আমি তো নবীদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছি। আর দাউদকে আমি যাবুর দিয়েছি। (বানী ইস্রাঈলঃ ৫৫)।

মুমিন হলেও সকলেই এক পর্যায়ের নয়, সে কথা হাদীসেও এসেছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “দুর্বল মুমিন অপেক্ষা সবল মুমিনই আল্লাহর নিকট অধিক উত্তম এবং প্রিয়। আর প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ আছে।” (মুসলিম)

দর্জায় পার্থক্য ও ভিন্নতার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ لَا يَسْتَوِي مِنكُم مَّنْ أَنفَقَ مِن قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِينَ أَنفَقُوا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوا ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবে না? অথচ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানা তো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে (তারা এবং পরবর্তীরা) সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা, যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত। (হাদীদঃ ১০)।

لَّا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۚ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا

অর্থাৎ, বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে তারা এবং যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে, তারা সমান নয়। যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে, যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন; আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর, যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহা পুরস্কার দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। (নিসা : ১৫)

أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ ۗ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদাবনত হয়ে এবং দাড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে, (সে কি তার সমান, যে তা করে না?) বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান? বুদ্ধিমান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।' (যুমারঃ ৯)

يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে বহু মর্যাদায় উন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। {মুজাদিলাহ ১১)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই জান্নাতে একশ’টি দরজা (মর্যাদা) রয়েছে, যা আল্লাহ তার পথে জিহাদকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন; দুটি দরজার মধ্যবর্তী ব্যবধান আসমান ও জমিনের মত। সুতরাং তোমরা (জান্নাত) চাইলে ফিরদাউস চেয়ো। কারণ তা হল জান্নাতের মধ্যভাগ ও জান্নাতের উপরিভাগ, আর তার উপরে রয়েছে রহমানের আরশ।” (বুখারী ২৭৯০ নং)

নবী (সাঃ) বলেছেন, “অবশ্যই জান্নাতীগণ তাদের উপরের বালাখানার অধিবাসীদের এমনভাবে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা আকাশের পূর্ব অথবা পশ্চিম দিগন্তে উজ্জ্বল অস্তগামী তারকা গভীর দৃষ্টিতে দেখতে পাও। এটি হবে তাদের মর্যাদার ব্যবধানের জন্য।” (সাহাবীগণ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! এ তো নবীগণের স্থান; তারা ছাড়া অন্যরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। তিনি বললেন, “অবশ্যই, সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ আছে! সেই লোকরাও (পৌছতে পারবে), যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে রসূলগণকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছে।” (বুখারী-মুসলিম)

হয়তোবা মহান আল্লাহ এক একটি গ্রহ-নক্ষত্রের মত জান্নাতসমূহকে বিন্যস্ত করেছেন। হতে পারে একটি গ্রহই হবে একজন জান্নাতীর একটি জান্নাত। অল্লাহু আ’লাম।

জান্নাত যে কত বিশাল, তা কল্পনার বাইরে। মহান আল্লাহ জান্নাতের বিশালতা সম্পর্কে বলেছেন,

وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ

অর্থাৎ, তোমরা প্রতিযোগিতা (ত্বরা) কর, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা এবং বেহেশ্তের জন্য, যার প্রস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সমান, যা ধর্মভীরুদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩৩)

سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ

অর্থাৎ, তোমরা অগ্রণী হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততার মত, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণে বিশ্বাসীদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। (হাদীদঃ ২১)।

মহাশূন্যে কত বিশাল জায়গা। সেই শূন্যগর্ভে রয়েছে লক্ষ-কোটি গ্রহনক্ষত্র। মানুষকে একটি করে দিয়েও কি তা পূর্ণ হবে? কোন কোন জান্নাতীর জন্য থাকবে দু’টি জান্নাত। মহান আল্লাহ বলেন,

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে দুটি (জান্নাতের) বাগান। (রাহমানঃ ৪৬)

উক্ত জান্নাতের কথা বর্ণনার পর মহান আল্লাহ আরো দু’টি জান্নাতের কথা উল্লেখ করে বলেছেন,

وَمِن دُونِهِمَا جَنَّتَانِ

অর্থাৎ, এই জান্নাত দু’টি ছাড়া আরো দু’টি জান্নাত রয়েছে। (রাহমানঃ ৬২)

মহান আল্লাহ দুই শ্রেণীর জান্নাতের গুণ ও সুখ-সামগ্রী বর্ণনায় পার্থক্যও রেখেছেন। প্রথম শ্রেণীর জান্নাত হবে নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের জন্য এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর জান্নাত হবে ডান হাত-ওয়ালাদের জন্য (যাদেরকে ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে।) (তাযকিরাহ, কুতুবী ৪৪০ পৃঃ)।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “দু’টি জান্নাত আছে, তার পাত্রসমূহ এবং সবকিছুই রৌপ্য-নির্মিত। আর দু’টি জান্নাত আছে, তার পাত্রসমূহ এবং সবকিছুই স্বর্ণ-নির্মিত।..” (বুখারী-মুসলিম)।

যেমন জান্নাতে বিভিন্ন ঝরনা আছে। এক একটি ঝরনা এক এক শ্রেণীর জান্নাতীর জন্য খাস হবে।

 সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শ্রেণীর জান্নাতী

জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান ‘অসীলাহ’

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মূসা (আঃ) স্বীয় প্রভুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জান্নাতীদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নমানের জান্নাতী কে হবে? আল্লাহ তাআলা উত্তর দিলেন, সে হবে এমন একটি লোক, যে সমস্ত জান্নাতীগণ জান্নাতে প্রবেশ করার পর (সর্বশেষে) আসবে। তখন তাকে বলা হবে, তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বলবে, হে প্রভু! আমি কিভাবে (কোথায়) প্রবেশ করব? অথচ সমস্ত লোক নিজ নিজ জায়গা দখল করেছে এবং নিজ নিজ অংশ নিয়ে ফেলেছে। তখন তাকে বলা হবে, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট যে, পৃথিবীর রাজাদের মধ্যে কোন রাজার মত তোমার রাজত্ব হবে? সে বলবে, প্রভু! আমি এতেই সন্তুষ্ট। তারপর আল্লাহ বলবেন, তোমার জন্য তাই দেওয়া হল। আর ওর সমতুল্য, ওর সমতুল্য, ওর সমতুল্য, ওর সমতুল্য (অর্থাৎ, ওর চার গুণ রাজত্ব দেওয়া হল)। সে পঞ্চমবারে বলবে, হে আমার প্রভু! আমি (ওতেই) সন্তুষ্ট। তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার জন্য এটা এবং এর দশগুণ (রাজত্ব তোমাকে দেওয়া হল)। এ ছাড়াও তোমার জন্য রইল সে সব বস্তু, যা তোমার অন্তর কামনা করবে এবং তোমার চক্ষু তৃপ্তি উপভোগ করবে। তখন সে বলবে, আমি ওতেই সন্তুষ্ট, হে প্রভু।

(মূসা (আঃ) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আর সর্বোচ্চ স্তরের জান্নাতী কারা হবে? আল্লাহ তাআলা বললেন, তারা হবে সেই সব বান্দা, যাদেরকে আমি চাই। আমি স্বহস্তে যাদের জন্য সম্মান-বৃক্ষ রোপণ করেছি এবং তার উপর সীলমোহর অংকিত করে দিয়েছি (যাতে তারা ব্যতিরেকে অন্য কেউ তা দেখতে না পায়)। সুতরাং কোন চক্ষু তা দর্শন করেনি, কোন কর্ণ তা শ্রবণ করেনি এবং কোন মানুষের মনে তা কল্পিতও হয়নি।” (মুসলিম)।

 জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান ‘অসীলাহ’


জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানের নাম অসীলাহ। যে স্থান সর্বোচ্চ মানুষের প্রাপ্য। আর তিনি হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)। তিনি বলেন, “মুআযযিনকে আযান দিতে শুনলে তোমরাও ওর মতই বল। অতঃপর আমার উপর দরূদ পাঠ কর; কেন না, যে ব্যক্তি আমার। উপর একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন। অতঃপর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট ‘অসীলাহ’ প্রার্থনা কর; কারণ, অসীলাহ’ হল জান্নাতের এমন এক সুউচ্চ স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একটি বান্দার জন্য উপযুক্ত। আর আমি আশা রাখি যে, সেই বান্দা আমিই। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য ঐ ‘অসীলাহ’ প্রার্থনা করবে, তার জন্য আমার শাফাআত (সুপারিশ) অবধার্য হয়ে যাবে।” (আহমাদ, মুসলিম ৩৮৪নং প্রমুখ, মিশকাত ৬৫৭নং)

 উচ্চ স্থানসমূহ কাদের জন্য?


জান্নাতের উচ্চ স্থানসমূহ শহীদদের জন্য। সেই শহীদদের জন্য, যারা প্রথম কাতারে থেকে যুদ্ধ করেন। যারা শহীদ হওয়া পর্যন্ত পিছন ফিরে তাকান না। এঁদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে হাসেন। এঁরাই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শহীদ। এঁদের কোন হিসাব নেই। এঁদের জন্যই রয়েছে জান্নাতের উচ্চ উচ্চ স্থান। (আহমাদ, সঃ জামে' ১১১৮নং)

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, রাতে দু’জন লোক আমার কাছে এসে আমাকে গাছের উপর চড়ালো এবং আমাকে একটি সুন্দর ও উত্তম ঘরে প্রবেশ করালো, ওর চাইতে সুন্দর (ঘর) আমি কখনো দেখিনি। তারা (দু’জনে) বলল, --- এই ঘরটি হচ্ছে শহীদদের ঘর। (বুখারী)

এমন কিছু কাজ আছে, যা করলে নবী (সাঃ)-এর কাছাকাছি দরজা পাওয়া যাবে। যেমনঃ

মহানবী (সাঃ) বলেন “আমি এবং নিজের অথবা অপরের অনাথ (এতীমের) তত্ত্বাবধায়ক জান্নাতে (পাশাপাশি) থাকব। আর বিধবা ও দুঃস্থ মানুষকে দেখাশুনাকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।” (ত্বাবারানীর আওসাত্ব, সহীহুল জামে’ ১৪৭৬নং)।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমি ও অনাথ (এতীমের) তত্ত্বাবধায়ক জান্নাতে এরূপ (পাশাপাশি) বাস করব।” এর সাথে তিনি তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দ্বারা ইঙ্গিত করলেন এবং দুটির মাঝে একটু ফাঁক করলেন।” (বুখারী ৫৩০৪নং)।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর খাদেম ও আহলে সুফফার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাবীআহ ইবনে কাব আসলামী বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সঙ্গে রাত কাটাতাম। আমি তাঁর কাছে ওযুর পানি এবং প্রয়োজনীয় বস্তু এনে দিতাম। (একদিন তিনি খুশী হয়ে) বললেন, “তুমি আমার কাছে কিছু চাও।” আমি বললাম, আমি আপনার কাছে জান্নাতে আপনার সাহচর্য চাই। তিনি বললেন, “এ ছাড়া আর কিছু?” আমি বললাম, বাস ওটাই। তিনি বললেন, “তাহলে তুমি, অধিকাধিক সিজদা করে (অর্থাৎ প্রচুর নফল নামায পড়ে) তোমার (এ আশা পূরণের) জন্য আমাকে সাহায্য কর।” (মুসলিম)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি দুটি অথবা তিনটি কন্যা, কিংবা দুটি অথবা তিনটি বােন তাদের মৃত্যু অথবা বিবাহ, অথবা সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত, কিংবা ঐ ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত যথার্থ প্রতিপালন করে, সে ব্যক্তি আর আমি (পরকালে) তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলিদ্বয়ের মত পাশাপাশি অবস্থান করব।” (আহমদ ৩/ ১৪৭ ১৪৮, ইবনে হিব্বান ২০ ৪৫ নং সিলসিলাহ সহীহাহ ২৯৬ নং)

যারা শহীদদের দর্জা পান, তারাও তাদের কাছাকাছি উচ্চ স্থান পাবেন জান্নাতে। যেমনঃ

১৷ বিধবা ও মিসকীনদের অভাব দূরকরণে চেষ্টারত ব্যক্তি।

নবী (সাঃ) বলেছেন, “বিধবা ও মিসকীনদের অভাব দূর করার চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।” (হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন) আমি ধারণা করছি যে, তিনি এ কথাও বললেন, “সে ঐ নফল নামায আদায়কারীর মত যে ক্লান্ত হয় না এবং ঐ রোযা পালনকারীর মত যে রোযা ছাড়ে না।” (বুখারী)।

২। আরো কতিপয় লোক।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “(পারলৌকিক পুরস্কারে পুরস্কৃত হওয়ার দিক দিয়ে) শহীদ পাঁচ ধরনের; (১) প্লেগরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত, (২) পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত, (৩) পানিতে ডুবে মৃত, (৪) মাটি চাপা পড়ে মৃত এবং (৫) আল্লাহর পথে থাকা অবস্থায় মৃত।” (বুখারী-মুসলিম)

একদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তোমরা তোমাদের মাঝে কোন কোন ব্যক্তিকে শহীদ বলে গণ্য কর?” সকলেই সমস্বরে বলে উঠল, 'হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর পথে যে নিহত হয়, সেই শহীদ। তিনি বললেন, “তাহলে তো আমার উম্মতের মধ্যে শহীদ বড় অল্প।” লোকেরা বলল, ‘তাহলে তারা কে কে হে আল্লাহর রসূল? তিনি বললেন, “যে আল্লাহর পথে নিহত হয় সে শহীদ, যে আল্লাহর পথে মারা যায় সে শহীদ, যে প্লেগ রোগে মারা যায় সে শহীদ, যে পেটের রোগে প্রাণ হারায়, সে শহীদ এবং যে পানিতে ডুবে মারা যায় সেও শহীদ।” (মুসলিম)।

তিনি আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার মাল-ধন রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজ রক্ত (প্রাণ) রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ। যে তার দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ এবং যে তার পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় সেও শহীদ।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, হাসান সহীহ)

কম দর্জার জান্নাতীর নেক সন্তানের দুআতে জান্নাতে তার দর্জা উঁচু হতে থাকে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ জান্নাতে নেক বান্দার দর্জা উঁচু করেন। সে তখন বলে, হে আমার প্রতিপালক! এ উন্নতি কীভাবে? আল্লাহ বলেন, তোমার জন্য তোমার ছেলের ক্ষমা প্রার্থনার ফলে।” (আহমাদ) আর তিনি বলেছেন, “আদম সন্তান মারা গেলে তার সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অবশ্য তিনটি আমল বিচ্ছিন্ন হয় না; সাদকাহ জা-রিয়াহ (ইষ্টাপূর্ত কর্ম), লাভদায়ক ইলম, অথবা নেক সন্তান যে তার জন্য দুআ করে থাকে।” (মুসলিম ১৬৩ ১নং প্রমুখ)

 জান্নাতের মাটি


জান্নাতের মাটি বিভিন্ন ধরনের হবে। কোথাও কস্তুরীর মত সুগন্ধময়। (বুখারী-মুসলিম)। আবার কোথাও জাফরানের মত। (আহমাদ, তিরমিযী, দারেমী)। আবার কোথাও হবে সাদা ধবধবে মিহি আটার মত। (মুসলিম, আহমাদ)

 জান্নাতের নদীমালা


জান্নাত মানে বাগান। আর বাগানে অবশ্যই নদী প্রবাহিত থাকবে। প্রথমতঃ তার পানি পান করা যাবে। আর দ্বিতীয়তঃ তাতে বাগানের শোভা-সৌন্দর্য চিত্তাকর্ষী হবে। মহান আল্লাহ জান্নাতের সেই বিবরণ দিয়েই বান্দার মনকে আকৃষ্যমান করেছেন। সুতরাং যেখানেই তিনি জান্নাতের কথা বলেছেন, প্রায় সেখানেই নদীমালার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমনঃ

وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ

অর্থাৎ, যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তাদের শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত; যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। (বাক্বারাহঃ ২৫)

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ يَهْدِيهِمْ رَبُّهُم بِإِيمَانِهِمْ ۖ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস করেছে এবং ভাল কাজ করেছে তাদের প্রতিপালক তাদের বিশ্বাসের কারণে তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন, শান্তির উদ্যানসমূহে তাদের (বাসস্থানের) তলদেশ দিয়ে নদীমালা প্রবাহিত থাকবে। (ইউনুসঃ ৯)

أُولَٰئِكَ لَهُمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ

অর্থাৎ, তাদেরই জন্য আছে স্থায়ী জান্নাত; যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। (কাহফঃ ৩১)।

মহানবী (সাঃ) মিরাজে গিয়ে জান্নাতের চারটি নদী দর্শন করেছিলেন। দু’টি বাহ্যিক ও দু’টি আভ্যন্তরিক। বাহ্যিক নদী দু’টি দুনিয়ায় প্রবহমান, নীল ও ফুরাত। (মুসলিম ১৬৪নং)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসুলল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “(শামের) সাইহান ও জাইহান, (ইরাকের) ফুরাত এবং (মিসরের) নীল প্রত্যেক নদীই জান্নাতের নদ-নদীসমূহের অন্যতম। (মুসলিম ২৮৩৯নং)।

উক্ত নদীগুলি জান্নাতের মানে হল, সেগুলির মূল জান্নাতের; যেমন মানুষের মূল হল জান্নাত। অথবা উক্ত নদীগুলির বিশেষ বকতের জন্য জান্নাতের নদী বলা হয়েছে। আর আল্লাহই ভাল জানেন।

জান্নাতের নদীমালার মধ্যে একটির নাম কাউষার; যা শেষ নবী (সাঃ)-কে হওযরূপে দান করা হয়েছে। (সুরা কাউষার) এ নদীর মাটি-কাদাও কস্তুরী। (বুখারী) যেখান হতে মহানবী (সাঃ) তাঁর উম্মতকে কিয়ামতে পানি পান করাবেন।

সুর্ববৃহৎ হওয ও কাউসার নহর (অমৃত নদী) থাকবে জান্নাতী শারাবে পরিপূর্ণ। যে পবিত্র শারাব বা পানীয় দুগ্ধ হতেও সাদা, বরফ হতেও শীতল, মধু হতেও মিষ্ট এবং মিসক চেয়েও সুগন্ধময়। যে একবার সে পানি পান। করবে তাকে আর কোনদিন পিপাসা স্পর্শ করবে না। (বুখারী ৬৫৭৯নং)

জান্নাতের নিম্নদেশে চারটি নহর প্রবাহিত। নির্মল পানির নহর, দুগ্ধের নহর; যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, সুস্বাদু সুধার নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। মহান আল্লাহ বলেন,

مَّثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۖ فِيهَا أَنْهَارٌ مِّن مَّاءٍ غَيْرِ آسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِّن لَّبَنٍ لَّمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّى ۖ وَلَهُمْ فِيهَا مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ

অর্থাৎ, সাবধানীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হলঃ ওতে আছে নির্মল পানির নদীমালা, আছে দুধের নদীমালা যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নদীমালা, আছে পরিশোধিত মধুর নদীমালা। আর সেখানে তাদের জন্য আছে বিবিধ ফলমূল ও তাদের প্রতিপালকের ক্ষমা। সাবধানীরা কি তাদের মত, যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং যাদেরকে পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি; যা তাদের নাড়ীভুড়ি ছিন্ন-ভিন্ন করে দেবে? (মুহাম্মাদঃ ১৫)।

এই চার শ্রেণীর নদীর কথা হাদীসেও রয়েছে। (আহমাদ, তিরমিযী) তবে হাদীসের শব্দে ‘বাহর’ বলা হয়েছে, যার অর্থ হয় সমুদ্র। অবশ্য ‘বাহর’ মানে বড় নদও করা হয়। আর সমুদ্র হলে সেটাই হবে নদীর উৎস, যেমন হাদীসে সে কথার উল্লেখ এসেছে।

জান্নাতের পানি, দুধ, শারাব, মধু প্রভৃতি দুনিয়ার মত নয়। এসব কিছুরই স্বাদ ভিন্ন এবং অপরিবর্তনীয়, বিনষ্ট হয় না, শারাবে জ্ঞান শূন্য হয় না, কোন শিরঃপীড়ায় ধরে না। (ওয়াক্বিআহঃ ১৯)।

জান্নাতের একটি নদীর নাম ‘বা-রিক্ব’। এটি জান্নাতের দ্বারপ্রান্তে অবস্থিত। এরই নিকটে শহীদগণের আত্মা অবস্থান করবে। (আহমাদ, হাকেম, ইবনে হিব্বান)

 জান্নাতের ঝরনাসমূহ


জান্নাতের আছে বিভিন্ন পানীয় ও স্বাদের ঝরনা। বাগানে ঝরনাও সৃষ্টি করে আকর্ষণীয় দৃশ্য। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَعُيُونٍ

অর্থাৎ, নিশ্চয় সাবধানীরা বাস করবে উদ্যান ও প্রস্রবণসমূহে। (হিজরঃ ৪৫, যারিয়াতঃ ১৫)

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي ظِلَالٍ وَعُيُونٍ

অর্থাৎ, আল্লাহ-ভীরুরা থাকবে ছায়া ও ঝরনাসমূহে। (মুরসালাতঃ ৪১)

فِيهِمَا عَيْنَانِ تَجْرِيَانِ

অর্থাৎ, উভয় (বাগানে) রয়েছে প্রবহমান দুই প্রস্রবণ। (রাহমানঃ ৫০)

فِيهِمَا عَيْنَانِ نَضَّاخَتَانِ

অর্থাৎ, উভয় বাগানে আছে উচ্ছলিত দুই প্রস্রবণ। (রাহমানঃ ৬৬)

জান্নাতের একটি ঝরনার পানি কপূর-মিশ্রিত। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الْأَبْرَارَ يَشْرَبُونَ مِن كَأْسٍ كَانَ مِزَاجُهَا كَافُورًا (5) عَيْنًا يَشْرَبُ بِهَا عِبَادُ اللَّهِ يُفَجِّرُونَهَا تَفْجِيرًا (6)

অর্থাৎ, নিশ্চয় সৎকর্মশীলরা পান করবে এমন পানীয় যার মিশ্রণ হবে কপূর। এমন একটি ঝরনা; যা হতে আল্লাহর দাসরা পান করবে, তারা এ (ঝরনা ইচ্ছামত) প্রবাহিত করবে। (দাহরঃ ৫-৬)।

অন্য একটি ঝরনা কস্তুরী-মিশ্রিত; যা তাসনীম’ নামে প্রসিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ (22) عَلَى الْأَرَائِكِ يَنظُرُونَ (23) تَعْرِفُ فِي وُجُوهِهِمْ نَضْرَةَ النَّعِيمِ (24) يُسْقَوْنَ مِن رَّحِيقٍ مَّخْتُومٍ (25) خِتَامُهُ مِسْكٌ ۚ وَفِي ذَٰلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ (26) وَمِزَاجُهُ مِن تَسْنِيمٍ (27) عَيْنًا يَشْرَبُ بِهَا الْمُقَرَّبُونَ (28)

অর্থাৎ, পুণ্যবানগণ তো থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে। তারা সুসজ্জিত আসনে বসে দেখতে থাকবে। তুমি তাদের মুখমন্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের সজীবতা দেখতে পাবে। তাদেরকে মোহর আঁটা বিশুদ্ধ মদিরা হতে পান করানো হবে। এর মোহর হচ্ছে কস্তুরীর। আর তা লাভের জন্যই প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতা করুক। এর মিশ্রণ হবে তাসনীমের (পানির)। এটা একটি প্রস্রবণ, যা হতে নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পান করবে। (মুত্বাফফিফীনঃ ২২-২৮)। আরো একটি ঝরনা ‘সালসাবীল’ নামে প্রসিদ্ধ। যার পানি আদার সুগন্ধমিশ্রিত। মহান আল্লাহ বলেন,

وَيُسْقَوْنَ فِيهَا كَأْسًا كَانَ مِزَاجُهَا زَنجَبِيلًا (17) عَيْنًا فِيهَا تُسَمَّىٰ سَلْسَبِيلًا (18)

অর্থাৎ, সেখানে তাদেরকে পান করতে দেওয়া হবে শুঠ-মিশ্রিত পানীয়। জান্নাতের এমন এক ঝরনার, যার নাম সালসাবীল”। (দাহরঃ ১৭-১৮)।

 জান্নাতের অট্টালিকা ও তাবুর বিবরণ


জান্নাতীরা জান্নাতে বড় বড় অট্টালিকায় বসবাস করবে। তা হবে একাধিক কক্ষবিশিষ্ট ও বহুতল। তা হবে সুখের বাসা ও সৌন্দর্যময়।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থাৎ, আল্লাহ বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদেরকে এমন উদ্যানসমূহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, যেগুলোর নিম্নদেশে বইতে থাকবে নদীমালা, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আরও (প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) চিরস্থায়ী উদ্যানসমূহে (জান্নাতে আদনে) পবিত্র বাসস্থানসমুহের। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় (নিয়ামত)। এটাই হচ্ছে অতি বড় সফলতা। (তওবাহঃ ৭২)।

وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُم بِالَّتِي تُقَرِّبُكُمْ عِندَنَا زُلْفَىٰ إِلَّا مَنْ آمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَٰئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوا وَهُمْ فِي الْغُرُفَاتِ آمِنُونَ

অর্থাৎ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আমার নৈকট্য লাভের সহায়ক হবে না। তবে (নৈকট্য লাভ করবে) তারাই যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে এবং তারা তাদের কাজের জন্য পাবে বহুগুণ পুরস্কার। আর তারা কক্ষসমূহে নিরাপদে বসবাস করবে। (সাবা’ : ৩৭)

أُولَٰئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوا وَيُلَقَّوْنَ فِيهَا تَحِيَّةً وَسَلَامًا

অর্থাৎ, তাদেরকে ধৈর্যাবলম্বনের প্রতিদান স্বরূপ (বেহেস্তের) কক্ষ দেওয়া হবে এবং তাদেরকে সেখানে অভিবাদন ও সালাম সহকারে অভ্যর্থনা জানানো হবে। (ফুরক্বানঃ ৭৫)

لَٰكِنِ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ غُرَفٌ مِّن فَوْقِهَا غُرَفٌ مَّبْنِيَّةٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ وَعْدَ اللَّهِ ۖ لَا يُخْلِفُ اللَّهُ الْمِيعَادَ

অর্থাৎ, তবে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য বহুতলবিশিষ্ট নির্মিত প্রাসাদ রয়েছে; যার নিম্নদেশে নদীমালা প্রবাহিত। (এটি) আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। (যুমারঃ ২০)

জান্নাতে এমন কক্ষ থাকবে, যা স্বচ্ছ স্ফটিক-নির্মিত।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “জান্নাতের মধ্যে এমন কক্ষ আছে, যার বাহিরের অংশ ভিতর থেকে এবং ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে।” তা শুনে আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বললেন, 'সে কক্ষ কার জন্য হবে, হে আল্লাহর রসুল?' তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, অন্নদান করে ও লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাযে রত হয়; তার জন্য।” (ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১১নং)

জান্নাতে রয়েছে বড় বড় তাবু। জান্নাতীরা সস্ত্রীক সেই তাঁবুতে বাস করবে। মহান আল্লাহ বলেন,

حُورٌ مَّقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ

অর্থাৎ, তারা তাবুতে সুরক্ষিত হুর। (রাহমানঃ ৭২)।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় জান্নাতে মুমিনদের জন্য একটি শূন্যগর্ভ মোতির তাঁবু থাকবে, যার দৈর্ঘ্য হবে ষাট মাইল। এর মধ্যে মুমিনদের জন্য একাধিক স্ত্রী থাকবে। যাদের সকলের সাথে মু’মিন সহবাস করবে। কিন্তু তাদের কেউ কাউকে দেখতে পাবে না। (বুখারী-মুসলিম)

এই তাবু হবে একটি মোতির। সে মোতি কত বিশাল যে, তার ভিতরের জায়গা হবে ষাট মাইল!

জান্নাতে বিশেষ কিছু লোকের জন্য বিশেষ ধরনের অট্টালিকা থাকবে। যেমন মা খাদীজা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)র জন্য থাকবে বংশ-নির্মিত প্রাসাদ। অবশ্য সে বংশ বা বাশ হবে মনি-মুক্তার। আল্লাহর রসূল (সাঃ) জিবরীলের পক্ষ থেকে খাদীজা (রাদ্বিয়াল্লাহু আহা)কে জান্নাতে (তার জন্য মুক্তার বাঁশ বা) ফাঁপা মুক্তা নির্মিত একটি অট্টালিকার সুসংবাদ দান করেছেন; যেখানে কোন হট্টগোল ও ক্লান্তি থাকবে না। (বুখারী ও মুসলিম)

জান্নাতে উমার (রাঃ)-এর প্রাসাদ মহানবী (সাঃ) দর্শন করেছেন। (বুখারী-মুসলিম)।

জান্নাতে অতিরিক্ত ঘর নির্মাণ করার জন্য কিছু অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। যেমনঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যে কোন মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য প্রত্যহ ফরয নামায ছাড়া বারো রাকআত সুন্নত নামায পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ করেন অথবা তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হয়।” (মুসলিম)।

আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি (কাতারের মাঝে) কোন ফাঁক বন্ধ করে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং তার জন্য জান্নাতে এক গৃহ নির্মাণ করেন।” (ত্বাবারানীর আওসাত্ব, সহীহ তারগীব ৫০২নং)।

নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কুল হুঅল্লা-হু আহাদ’ শেষ পর্যন্ত ১০ বার পাঠ করবে, আল্লাহ সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি মহল নির্মাণ করবেন।” (আহমাদ, প্রমুখ, সিসিলাহ সহীহাহ ৫৮৯নং)।

রাসূলল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যখন কোন বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন মহান আল্লাহ স্বীয় ফিরিশাদেরকে বলেন, তোমরা আমার বান্দার সন্তানের জীবন হনন করেছ কি? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তোমরা তার হৃদয়ের ফলকে হনন করেছ কি? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, সে সময় আমার বান্দা কি বলেছে? তারা বলে, সে আপনার হামদ (প্রশংসা) করেছে ও ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (অর্থাৎ, আমরা তোমার এবং তোমার কাছেই অবশ্যই ফিরে যাব) পাঠ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, আমার (সন্তানহারা) বান্দার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ কর, আর তার নাম রাখ, বায়তুল হামদ’ (প্রশংসাভবন)।” (তিরমিযী হাসান)।

আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেছেন, “অন্যায়ের সপক্ষে থেকে যে ব্যক্তি তর্ক পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের পার্শ্বদেশে এক গৃহ নির্মাণ করা হয়। ন্যায়ের সপক্ষে থেকেও যে ব্যক্তি তর্ক পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে এক গৃহ নির্মাণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে সুন্দর করে তার জন্য জান্নাতের উপরিভাগে এক গৃহ নির্মাণ করা হয়।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, বাইহাকী, সহীহ তারগীব ১৩৩নং)।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করে (নিম্নের দুআ) বলে, আল্লাহ তার জন্য দশ লক্ষ নেকী লিপিবদ্ধ করেন, দশ লক্ষ গোনাহ মোচন করে দেন, তাকে দশ লক্ষ মর্যাদায় উন্নীত করেন এবং বেহেস্তে তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করে দেন।”

'লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু অলাহুল হামদু, য়্যুহয়ী অয়ুমীতু, অহুয়া হাইয়ুল লা য্যামূতু, বিয়াদিহিল খাইরু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর। (সহীহ তিরমিযী ২৭ ২৬ নং, সহীহ ইবনে মাজাহ ১৮১৭ নং)

নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর (সন্তুষ্টি লাভের) উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেয়, আল্লাহ তার জন্য বেহেশ্যে একটি ঘর বানিয়ে দেন।” (বুখারী, মুসলিম, মিঃ ৬৯৭নং)

 জান্নাতের জ্যোতি


জান্নাতে থাকবে নিরবচ্ছিন্ন আলো। সেখানে চন্দ্র-সূর্য নেই, রাত-দিন নেই। সূর্যের তাপ নেই। মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ

অর্থাৎ, সেখানে তুমি পিপাসার্ত হবে না এবং রোদ্র-ক্লিষ্টও হবে না। (ত্বাহাঃ ১১৯)।

مُّتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَائِكِ ۖ لَا يَرَوْنَ فِيهَا شَمْسًا وَلَا زَمْهَرِيرًا

অর্থাৎ, সেখানে তারা সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে, তারা সেখানে রৌদ্রতাপ অথবা অতিশয় শীত বোধ করবে না। (দাহরঃ ১৩)

প্রয়োজনে হয়তো দরজা বা পর্দা লাগিয়ে অন্ধকার করা যাবে। অবশ্য বিশেষ জ্যোতি দ্বারা সকাল-সন্ধ্যা চেনার অন্য ব্যবস্থা থাকবে। (দ্রঃ ইবনে কাসীর ৪/৪৭১, মাজমুউ ফাতাওয়া ৪/৩১২)

 জান্নাতের সুগন্ধি


জান্নাত সুগন্ধময় জায়গা। তার সুগন্ধ কেবল ভিতরেই নয়, বরং তার বাইরে বহু দুরবর্তী স্থান থেকে পাওয়া যাবে। কত দূরবর্তী জায়গা থেকে পাওয়া যাবে, তার উল্লেখ কতিপয় হাদীসে এসেছে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, দুই প্রকার জাহান্নামী আমি (এখন পর্যন্ত) প্রত্যক্ষ করিনি (অর্থাৎ, পরে তাদের আবির্ভাব ঘটবে) : (১) এক সম্প্রদায় যাদের কাছে গরুর লেজের মত চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা জনগণকে প্রহার করবে। (২) এক শ্রেণীর মহিলা, যারা (এমন নগ্ন) পোশাক পরবে যে, (বাস্তবে) উলঙ্গ থাকবে, (পর পুরুষকে) নিজেদের প্রতি আকর্ষণ করবে ও নিজেরাও (পর পুরুষের প্রতি) আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা হবে উটের হিলে যাওয়া কুঁজের মত। এ ধরনের মহিলারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধ এত এত দূরত্বের পথ থেকে পাওয়া যাবে। (মুসলিম)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি পরের বাপকে নিজের বাপ বলে দাবী করে, সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধি ৫০০ বছরের দূরবর্তী স্থান থেকেও পাওয়া যাবে।” (আহমাদ ২/১৭ ১, ইবনে মাজাহ ২৬১১, সহীহুল জামে ৫৯৮৮নং)

আহমাদের এক বর্ণনায় আছে ৭০ বছরের দূরবর্তী স্থান থেকেও পাওয়া যাবে। (সঃ তারগীব ১৯৮৮নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন সন্ধি অথবা চুক্তিবদ্ধ (যিম্মী) মানুষকে হত্যা করবে, সে ব্যক্তি জান্নাতের সুবাসও পাবে না। অথচ তার সুবাস ৪০ বছরে অতিক্রম্য দূরবর্তী স্থান থেকেও পাওয়া যাবে।” (আহমাদ, বুখারী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে’ ৬৪৫৭নং)

এক বর্ণনায় ৭০ ও ১০০ বছরে অতিক্রম্য দূরবর্তী স্থানের কথা আছে। (সঃ তারগীব ২০৪৪নং)

 জান্নাতের বৃক্ষরাজি ও ফলমূল

 শেয়ার ও অন্যান্য 

জান্নাতের আছে, সারি সারি নানা রকম বৃক্ষরাজি। আছে নানা রকমের ফলমূল। কিছু বৃক্ষ ও ফলমূলের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا (31) حَدَائِقَ وَأَعْنَابًا (32)

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহভীরুদের জন্যই রয়েছে সফলতা; উদ্যানসমূহ ও নানাবিধ আঙ্গুর। (নাবা’ ৩১-৩২) ।

فِيهِمَا مِن كُلِّ فَاكِهَةٍ زَوْجَانِ

অর্থাৎ,উভয় (বাগানে) রয়েছে প্রত্যেক ফল দুই প্রকার। (রাহমানঃ ৫২)

فِيهِمَا فَاكِهَةٌ وَنَخْلٌ وَرُمَّانٌ

অর্থাৎ, সেখানে রয়েছে ফলমূল খেজুর ও ডালিম। (রাহমানঃ ৬৮)

وَأَصْحَابُ الْيَمِينِ مَا أَصْحَابُ الْيَمِينِ (27) فِي سِدْرٍ مَّخْضُودٍ (28) وَطَلْحٍ مَّنضُودٍ (29)

অর্থাৎ, আর ডান হাত-ওয়ালারা, কত ভাগ্যবান ডান হাত-ওয়ালারা! (যাদেরকে ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে। তারা থাকবে এক বাগানে) সেখানে আছে কাটাহীন কুলগাছ। কাঁদি ভরা কলাগাছ। (ওয়াক্বিআহঃ ২৭-২৯)

وَفَاكِهَةٍ مِّمَّا يَتَخَيَّرُونَ

অর্থাৎ, তাদের পছন্দ মত ফলমূল। (ওয়াক্বিআহঃ ২০)।

مُتَّكِئِينَ فِيهَا يَدْعُونَ فِيهَا بِفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ وَشَرَابٍ

অর্থাৎ, সেখানে তারা আসীন হবে হেলান দিয়ে, সেখানে তারা যত খুশী ফলমূল ও পানীয়ের জন্য আদেশ দেবে। (স্বাদঃ ৫১)

يَدْعُونَ فِيهَا بِكُلِّ فَاكِهَةٍ آمِنِينَ

অর্থাৎ, সেখানে তারা নিশ্চিন্তে বিবিধ ফলমূল আনতে বলবে। (দুখনঃ ৫৫)

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي ظِلَالٍ وَعُيُونٍ (41) وَفَوَاكِهَ مِمَّا يَشْتَهُونَ (42) كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ (43) إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (44)

অর্থাৎ, আল্লাহ-ভীরুরা থাকবে ছায়া ও ঝরনাসমূহে। তাদের বাঞ্ছিত ফলমুলের প্রাচুর্যের মধ্যে। তোমরা তোমাদের কর্মের পুরস্কার স্বরূপ তৃপ্তির সাথে পানাহার কর। এভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। (মুরসালাতঃ ৪১-৪৪)

জান্নাতের ফলসমূহের নাম দুনিয়ার ফলের মত হলেও, সে সবের স্বাদ কিন্তু এক নয়। যেহেতু জান্নাতের সবকিছুই অতুলনীয়, বেনযীর।

وَبَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ كُلَّمَا رُزِقُوا مِنْهَا مِن ثَمَرَةٍ رِّزْقًا ۙ قَالُوا هَٰذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِن قَبْلُ ۖ وَأُتُوا بِهِ مُتَشَابِهًا

অর্থাৎ, যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তাদের শুভ সংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত; যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, যখনই তাদের ফলমূল খেতে দেওয়া হবে, তখনই তারা বলবে, আমাদেরকে (পৃথিবীতে অথবা জান্নাতে) পূর্বে জীবিকারূপে যা দেওয়া হত, এ তো তাই। তাদেরকে পরস্পর একই সদৃশ ফল দান করা হবে। (বাক্বারাহঃ ২৫)

(সদৃশ) এর অর্থ হয়তোবা জান্নাতের সমস্ত ফলের আকার-আকৃতি এক রকম হবে অথবা তা দুনিয়ার ফলের মত দেখতে হবে। তবে এ সাদৃশ্য কেবল আকার ও নাম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। নচেৎ জান্নাতের ফলের স্বাদের সাথে দুনিয়ার ফলের স্বাদের কোন তুলনাই নেই। জান্নাতের নিয়ামতের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, “(এমন নিয়ামত) যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি এবং কোন মানুষের অন্তরে তার সঠিক ধারণা উদয় হয়নি।”

জান্নাতের সমস্ত ফল-গাছই বারোমেসে। জান্নাতের ফল এমন মৌসমী ফল হবে না যে, মৌসম শেষ হয়ে গেলেই সেই ফল আগামী মৌসম পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জান্নাতের ফল এ ধরনের ফুল-মুকুলের ঋতুর অধীনস্থ হবে না। বরং তা সদা-সর্বদা পাওয়া যাবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ (32) لَّا مَقْطُوعَةٍ وَلَا مَمْنُوعَةٍ (33)

অর্থাৎ, প্রচুর ফলমূল; যা শেষ হবে না ও নিষিদ্ধও হবে না। (ওয়াক্বিআহঃ ৩২-৩৩)।

مَّثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۖ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ۖ أُكُلُهَا دَائِمٌ وَظِلُّهَا ۚ تِلْكَ عُقْبَى الَّذِينَ اتَّقَوا ۖ وَّعُقْبَى الْكَافِرِينَ النَّارُ

অর্থাৎ, সাবধানীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার বিবরণ এইরূপ ও ওর পাদদেশে নদী প্রবাহিত, ওর ফলমূলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী; যারা সাবধানী এটা তাদের পরিণাম। আর অবিশ্বাসীদের পরিণাম হল জাহান্নাম। (রা’দঃ ৩৫)

জান্নাতের ফল গাছের ডালে ঝুলে থাকলেও তা জান্নাতীর হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে। তা পেড়ে খেতে কোন প্রকারের কষ্টবরণ বা শ্রমব্যয় করতে হবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

قُطُوفُهَا دَانِيَةٌ

অর্থাৎ, যার ফলরাশি ঝুলে থাকবে নাগালের মধ্যে। (হা-ক্বাহঃ ২৩)

وَدَانِيَةً عَلَيْهِمْ ظِلَالُهَا وَذُلِّلَتْ قُطُوفُهَا تَذْلِيلًا

অর্থাৎ, সন্নিহিত বৃক্ষছায়া তাদের উপর থাকবে এবং ওর ফলমূল সম্পূর্ণরূপে তাদের আয়ত্তাধীন করা হবে। (দাহরঃ ১৪)

مُتَّكِئِينَ عَلَىٰ فُرُشٍ بَطَائِنُهَا مِنْ إِسْتَبْرَقٍ ۚ وَجَنَى الْجَنَّتَيْنِ دَانٍ

অর্থাৎ, সেখানে তারা হেলান দিয়ে বসবে পুরু রেশমের আস্তরবিশিষ্ট বিছানায়, দুই বাগানের ফল হবে তাদের নিকটবর্তী। (রাহমানঃ ৫৪)

জান্নাতের বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা ও পত্র-পল্লবের কথাও মহান আল্লাহর আল-কুরআনে উল্লেখ করেছেন। এক স্থানে বলেছেন,

ذَوَاتَا أَفْنَانٍ

অর্থাৎ, উভয়ই বহু ডালপালাবিশিষ্ট (গাছে পরিপূর্ণ)। (রাহমানঃ ৪৮)

অন্য স্থানে বলেছেন,

مُدْهَامَّتَانِ

অর্থাৎ, ঘন সবুজ এ (জান্নাতের) বাগান দু’টি। (রাহমানঃ ৬৪)

আর তার জন্যই তার ছায়া হবে ঘন। ছায়ার কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيلًا

অর্থাৎ, তাদেরকে চিরস্নিগ্ধ ঘন ছায়ায় স্থান দান করব। (নিসাঃ ৫৭)

জান্নাতে সূর্য নেই। সুতরাং সেখানে সর্বদা সর্বস্থানে ছায়া আর ছায়া। মহান আল্লাহ বলেন,

وَظِلٍّ مَّمْدُودٍ

অর্থাৎ, সম্প্রসারিত ছায়া। (ওয়াক্বিআহঃ ৩০)

إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي ظِلَالٍ وَعُيُونٍ

অর্থাৎ, আল্লাহ-ভীরুরা থাকবে ছায়া ও ঝরনাসমূহে। (মুরসালাতঃ ৪১)।

هُمْ وَأَزْوَاجُهُمْ فِي ظِلَالٍ عَلَى الْأَرَائِكِ مُتَّكِئُونَ

অর্থাৎ, তারা এবং তাদের স্ত্রীগণ সুশীতল ছায়ায় থাকবে এবং হেলান দিয়ে বসবে সুসজ্জিত আসনে। (ইয়াসীনঃ ৫৬)

জান্নাতে আছে বিশাল বিশাল গাছ। একটি গাছের কথা উল্লেখ করে নবী (সাঃ) বলেছেন, “জান্নাতের মধ্যে এমন একটি বৃক্ষ আছে, যার ছায়ায় কোন আরোহী উৎকৃষ্ট, বিশেষভাবে প্রতিপালিত হালকা দেহের দ্রুতগামী ঘােড়ায় চড়ে একশো বছর চললেও তা অতিক্রম করতে সক্ষম হবে না।” (বুখারী-মুসলিম)।

জান্নাতে ‘তুবা’ নামের একটি গাছ আছে। এ গাছটি ১০০ বছরের অতিক্রম্য জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এর মোছা থেকে জান্নাতীদের বস্ত্র নির্মিত হবে। (আহমাদ, সিঃ সহীহাহ ১৯৮৫নং)।

জান্নাতুল মাওয়ার কাছে ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’র কথা কুরআনে এসেছে,

وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ (13) عِندَ سِدْرَةِ الْمُنتَهَىٰ (14) عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ (15) إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَىٰ (16) مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ (17) لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَىٰ (18)

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার নিকট অবস্থিত (জান্নাতুল মাওয়া) বাসােদ্যান। যখন (বদরী) বৃক্ষটিকে, যা আচ্ছাদিত করার ছিল তা আচ্ছাদিত করল, তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। নিঃসন্দেহে সে তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিল। (নাজমঃ ১৩-১৮)

এটা হল মিরাজের রাতে যে জিবরীল (আঃ)-কে তাঁর আসল আকৃতিতে দেখেছিলেন, তারই বর্ণনা। এই সিদৰাতুল মুন্তাহা’ হল ষষ্ঠ বা সপ্তম আসমানে অবস্থিত একটি কুল (বরই) গাছ। যার ফলগুলি কলসের মত বড় বড় এবং পাতাগুলি হাতির কানের মত ঢােলা ঢােলা। (বুখারী-মুসলিম)

 জান্নাতের বৃক্ষ-কাণ্ড


জান্নাতের প্রত্যেক গাছের কাণ্ড হবে সোনার। (তিরমিযী) সুতরাং জান্নাতের বাগান যে কত সৌন্দর্যময় হবে, তা অনুমেয়। আর সে বাগানে বসবাসকারীরা কত সৌভাগ্যবান হবে, তাও অনুমেয়।

 জান্নাতে বৃক্ষ-সংখ্যা বৃদ্ধি করার উপায়


পরিবেশ রক্ষা ও সুন্দর করার জন্য গাছ লাগানো একটি উত্তম কাজ। দুনিয়ায় গাছ লাগিয়ে আমরা পরিবেশকে মনোরম করতে পারি। আমরা গাছ থেকে অক্সিজেন পাই, ছায়া পাই, খাদ্য পাই, সুগন্ধ পাই। আমরা বলে থাকি, গাছ লাগান, গাছ বাঁচান। একটি গাছ, একটি প্রাণ। গাছ লাগিয়ে আমরা আমাদের বাড়ির বাগানকে সুন্দর করি। কিন্তু পরকালের বাড়িকে সুন্দর করার কথা কি ভাবি?

আমরা কি জানি যে, সেখানেও গাছ লাগানো যাবে এই দুনিয়া থেকেই, গাছ থাকলেও গাছ আরো বৃদ্ধি করা যাবে?

মহানবী (সাঃ) (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি 'সুবহানাল্লাহি অবিহামদিহ’ পড়ে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি খেজুর বৃক্ষ রোপণ করা হয়।” (তিরমিযী)

তিনি আরো বলেছেন, “মিরাজের রাতে ইব্রাহীম (আঃ)-এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ! তুমি তোমার উম্মতকে আমার সালাম পেশ করবে এবং তাদেরকে বলে দেবে যে, জান্নাতের মাটি পবিত্র ও উৎকৃষ্ট, তার পানি মিষ্ট। আর তা একটি বৃক্ষহীন সমতলভূমি। আর ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ হল তার রোপিত বৃক্ষ।” (তিরমিযী)

 জান্নাতের খোশবু