Posts

আকিদার সারসংক্ষেপ ll Akidar Sarsongkhep ll Published By: dinislam.xyz

আকিদার সারসংক্ষেপ

ভূমিকা

إن الحمد لله نحمده و نستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضل

  فلا هادي له وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له و أشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد

অত্র পুস্তিকাটি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিভিন্নমুখী গবেষণা-প্রবন্ধের সমষ্টি, যা সকল মুসলিমকে নির্ভেজাল তওহীদের আকীদার (একত্ববাদের বিশ্বাসের) প্রতি আহ্বান করে এবং অধিকাংশ ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে প্রচলিত শির্ক হতে সুদূরে থাকতে আবেদন করে। যে শির্ক পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ধ্বংসের এবং বর্তমান পৃথিবীর দুর্গতি ও দুর্দশার মূল কারণ। বিশেষ করে মুসলিম জাহান যার কারণে শতমুখী বিপদ, দূরবস্থা, যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন।

এই গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও বিষয়াবলী ফির্কাহ নাজিয়াহ অ তায়েফাহ মনসূরাহ’ (মুক্তি প্রাপক দল এবং সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত)এর আকীদাহ ও বিশ্বাস স্পষ্টাকারে বিবৃত করবে- যেমন হাদীসে নববীতে বর্ণিত হয়েছে। যাতে জগদ্বাসীর জন্য সত্য পথ আলোকিত ও স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং তারা মোক্ষ ও সাহায্যপ্রাপ্ত হতে পারে। ইনশা-আল্লাহ।

আল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা করি, যেন তিনি এই পুস্তিকা দ্বারা সমগ্র মুসলিম জাতিকে উপকৃত করুন এবং তা একমাত্র তার সন্তুষ্টির জন্য বিশুদ্ধ করুন।

মুহাম্মদ বিন জামীল যইনু।

 মুক্তিপ্রাপ্ত দল

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর রশিকে (ধর্ম বা কুরআন)কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ে পড়ো না। (সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত)

২। তিনি আরো বলেন,

وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

অর্থাৎ, আর অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা দ্বীন সম্বন্ধে নানামতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। (সূরা রুম ৩২ আয়াত)।

৩। রসূল (সা.) বলেন, “আমি তোমাদেরকে আল্লাহ-ভীতি এবং (নেতার নেতৃত্ব) মান্য ও আনুগত্য করতে অসিয়ত করছি; যদিও তোমাদের নেতা একজন হাবশী ক্রীতদাস হয়। যেহেতু তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পরও জীবিত থাকবে সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নত (আদর্শ) এবং সুপথ প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত (আদর্শ) অবলম্বন করো, তা শক্ত করে ধারণ করো এবং দন্ত দ্বারা দৃঢ়ভাবে ধরো। আর অভিনব কর্মাবলী হতে দূরে থেকো। যেহেতু প্রত্যেক অভিনব কর্ম বিদ্আত, প্রত্যেক বিদ্আত ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিয়ে যায়।” (হাদীসটিকে নাসাঈ এবং তিরমিযী বর্ণনা করেছেন তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ)

৪। তিনি আরো বলেন, “সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ইয়াহুদী ৭১ ও খ্রিষ্টানরা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে, আর এই মিল্লাত (উম্মত) ৭৩ দলে বিভক্ত হবে; ৭২ টি দল জাহান্নামে যাবে এবং একটি যাবে জান্নাতে আর সেটি হল জামাআত।” (হাদীসটিকে আহমদ প্রমুখ বর্ণনা করেছেন এবং হাফেয হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)।

দ্বিতীয় এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “কেবল একটি দল ব্যতীত সবগুলি জাহান্নামে যাবে; যে দলটি আমি ও আমার সাহাবার মতানুসারী হবে।” (হাদীসটিকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহুল জামে' (৫২১৯)তে এটিকে হাসান বলেছেন।)।

৫৷ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (সা.) আমাদের জন্য স্বহস্তে একটি রেখা টানলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “এটি আল্লাহর সরল পথ।” অতঃপর ঐ রেখার ডাইনে ও বামে কতকগুলি রেখা টেনে বললেন, “এগুলি বিভিন্ন পথ। এই পথগুলির প্রত্যেটির উপর একটি করে শয়তান আছে; যে ঐ পথের প্রতি মানুষকে আহ্বান করে।” অতঃপর তিনি আল্লাহ তাআলার এই বাণী পাঠ করলেন,

وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

অর্থাৎ, এবং নিশ্চয় এটি আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না। করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে। এ ভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা সাবধান হও। (সূরা আনআম ১৫৩ আয়াত) (হাদীসটি সহীহ এটিকে আহমদ ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন।)

৬। শায়খ (পীর) আব্দুল কাদের জীলানী তাঁর গ্রন্থ গুনয়্যাহ’তে বলেন, আহলে সুন্নাহ অল জামাআতই ফির্কাহ নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল)। আর আহলে সুন্নাহর একটি নাম ছাড়া অন্য কোন নাম নেই। আর তা হল আসহাবুল হাদীস।

৭। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আমাদেরকে আদেশ করেন যে, আমরা যেন কুরআন করীমকে শক্তভাবে ধারণ করি এবং সেই মুশরেকিন (পৌত্তলিক)দের দলভুক্ত না হই যারা স্বধর্মে বিভিন্ন দল ও জামাআত সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রসূল করীম ঐ আমাদেরকে জানান যে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা বহু দলে বিভক্ত হয়েছে আর মুসলিমরা তাদের চেয়ে আরো অধিক দলে বিভক্ত হবে। সত্য পথ হতে বিচ্যুত হওয়ার কারণে এবং আল্লাহর কিতাব ও নবী (সা.)র সুন্নাহ হতে দূরে থাকার ফলে এই সকল ফির্কাহগুলি জাহান্নামের শিকার হবে। এদের। মধ্যে একটি ফির্কাহই জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভ করে জান্নাত প্রবেশ করবে; আর এই ফির্কাহ হল সেই জামাআত, যে কিতাব ও সহীহ সুন্নাহ এবং রসূল (সা.)-এর চরিত্রকে (নিজেদের আদর্শরূপে) শক্তভাবে ধারণ করবে।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে ফির্কাহ নাজিয়াহর দলভুক্ত কর এবং সমগ্র মুসলমানকে ঐ দলভুক্ত হওয়ার তওফীক দান কর।

 ফির্কাহ নাজিয়াহর মতাদর্শ

১। ফির্কাহ নাজিয়াহ (মুক্তি প্রাপ্ত দল), যে ফির্কাহ রসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ ও তাঁর পর তাঁর সাহাবাগণের মতাদর্শের অনুসারী। আর সে আদর্শ হল কুরআন করীম; যা আল্লাহ তার রসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং রসূল তার সাহাবাগণের নিকট তা সহীহ হাদীসে ব্যাখ্যা করেছেন এবং (ঐ কিতাব ও তার ব্যাখ্যা বা সুন্নাহ) উভয়কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। হওয’ (কাওসারে) আমার নিকট অবতরণ না করা পর্যন্ত তা বিচ্ছিন্ন হবে না।” (হাদীসটিকে আলবানী সহীহুল জামে’তে সহীহ বলেছেন।)

২। ফির্কাহ নাজিয়াহ বিতর্ক ও মতানৈক্যের সময় আল্লাহর বাণীর অনুসারী হয়ে তাঁর এবং তাঁর রসূলের উক্তির প্রতি রুজু করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا

(অর্থাৎ, আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মতভেদ ঘটে তবে সে বিষয় তোমরা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ফিরিয়ে দাও এটিই তো উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (সূরা নিসা ৫৯ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অর্থাৎ, কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হতে পারবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার তোমার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে না নেয়। (সূরা নিসা ৬৫ আয়াত)

৩। ফির্কাহ নাজিয়াহ আল্লাহর বাণীর অনুসারী হয়ে আল্লাহ এবং তার রসূলের উক্তির উপর কারো উক্তিকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তার রসূলের সম্মুখে তোমরা কোন বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ অবশ্যই সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। (সূরা হুজুরাত ১ আয়াত)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'আমার মনে হয় ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বলছি, নবী (সা.) বলেছেন’ আর ওরা বলছে, আবু বকর ও উমর বলেছেন। (এটিকে আহমদ প্রভৃতিগণ বর্ণনা করেছেন ও আহমাদ শাকের এটিকে সহীহ বলেছেন)

৪। ফির্কাহ নাজিয়াহর বিবেচনায় তওহীদ হল, সকল প্রকার ইবাদত; যেমন, দুআ বা প্রার্থনা, সাহায্য ভিক্ষা, বিপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে আহ্বান, যবেহ, নযরনিয়ায, ভরসা, আল্লাহর বিধান অনুসারে বিচার ও শাসন করা ইত্যাদিতে আল্লাহকে একক মানা। এটাই হল সেই বুনিয়াদ যার উপর সঠিক ইসলামী রাষ্ট্র রচিত হয়। সুতরাং অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলিতে বর্তমানে যে শির্ক এবং তার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে তা দুরীভূত করা একান্ত জরুরী। যেহেতু তা তওহীদের এক দাবী। সে জামাআতের বিজয় অসম্ভব যে জামাআত তওহীদকে অবহেলার সাথে উপেক্ষা করে এবং সকল রসূল ও বিশেষ করে আমাদের সম্মানিত রসূল (সা.) সালাওয়াতুল্লাহি অসালামুহু আলাইহিম আজমাঈন -কে আদর্শ মেনে সর্বপ্রকার শির্কের বিরুদ্ধে অবিশ্রাম সংগ্রাম না করে।

৫। ফির্কাহ নাজিয়াহ তার ইবাদতে, ব্যবহারে ও আচরণে বরং সারা জীবনে। রসূল (সা.) ৪-এর সুন্নাহকে জীবিত করে। যার কারণে এত লোকের মাঝে তারা। (প্রবাসীর মত) মুষ্টিমেয় ও বিরল। যেমন রসূল (সা.) তাদের প্রসঙ্গে অবহিত করে বলেছেন, “নিশ্চয় ইসলাম (প্রবাসীর মত অসহায়) অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে শুরুতে আগমন করেছে এবং অনুরূপ অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়েই ভবিষ্যতে প্রত্যাগমন করবে যেমন শুরুতে আগমন করেছিল। সুতরাং সুসংবাদ ঐ মুষ্টিমেয় লোকেদের জন্য।” (হাদীসটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন)।

অন্য এক বর্ণনায় আছে,“--- সুতরাং শুভ সংবাদ ঐ (প্রবাসীর মত অসহায়) অল্প সংখ্যক লোকদের জন্য যারা মানুষ অসৎ হয়ে গেলে তাদেরকে সংস্কার করে সঠিক পথে রাখতে সচেষ্ট হয়। (আলবানী বলেন এটিকে আবূ আমর আদ্‌দা-নী সহীহ সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন)।

৬। ফির্কাহ নাজিয়াহ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের উক্তি ছাড়া আর কারো উক্তি ও কথার পক্ষপাতিত্ব করে না। যে রসূল ছিলেন নিষ্কলুষ এবং যিনি নিজের খেয়াল-খুশী মতে কোন কথা বলতেন না। কিন্তু তিনি ব্যতীত অন্য মানুষ, যতই তিনি বহুমুখী মর্যাদার অধিকারী হন না কেন, ভুল করতেই পারেন। নবী (সা.) বলেন, “প্রত্যেক আদম সন্তান ক্রটিশীল ও অপরাধী, আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম লোক তারা যারা তওবা করে।” (হাদীসটি হাসান এটিকে আহমদ বর্ণনা করেছেন)।

ইমাম মালেক বলেন, 'নবী (সা.) এর পর তিনি ব্যতীত প্রত্যেকেরই কথা গ্রহণ করা বা উপেক্ষাও করা যাবে। (অর্থাৎ তিনি ব্যতীত অন্য সকলের অভিমত ও উক্তি গ্রহণীয় এবং উপেক্ষণীয়ও।)

৭। ফির্কাহ নাজিয়াহ হল ‘আহলে হাদীস। যাদের সম্পর্কে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এক দল চিরকাল হক (সত্যের) উপর বিজয়ী থাকবে আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্বমুহূর্ত) আসা পর্যন্ত, যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে ।” (এটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন। কবি বলেন,

“আহলে হাদীসরা আহলে নবী, যদিও

তারা তাঁর ব্যক্তিত্বের সাহচর্যে ছিল না।

কিন্তু তারা তাঁর বাণীর সংসর্গে থাকে।”

৮। ফির্কাহ নাজিয়াহ আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীন (মুজতাহিদ সকল ইমাম)কে শ্রদ্ধা করে। তাদের মধ্যে কোন একজনের একতরফা পক্ষপাতিত্ব করে না। বরং ফিকহ (দ্বীনের জ্ঞান) গ্রহণ করে কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহ হতে এবং তাঁদের উক্তি সমূহ হতেও -যদি তা সহীহ হাদীসের অনুসারী হয়। আর এই নীতিই তাদের নির্দেশের অনুকুল। যেহেতু তাঁরা সকলেই নিজ নিজ। অনুসারীগণকে সহীহ হাদীসের মত গ্রহণ করতে এবং এর প্রতিকুল প্রত্যেক মত ও উক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে অসিয়ত করে গেছেন।

৯। ফির্কাহ নাজিয়াহ সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করে। এই দল বিদআতী সকল নীতি এবং সর্বনাশী দলসমুহকে প্রতিহত করে। যে দলসমূহ উম্মতকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে ও দ্বীনে বিদআত রচনা করে রসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবার সুন্নাহ (ও নীতি) থেকে দূরে সরে আছে।

১০। ফির্কাহ নাজিয়াহ সমগ্র মুসলিম জাতিকে রসূল (সা.) ও তার সাহাবাগণের সুন্নাহ (তরীকা)কে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে আহবান করে। যাতে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত হয় এবং আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর রসূল (সা.)-এর সুপারিশে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে।

১১। ফির্কাহ নাজিয়াহ মনগড়া সমস্ত মানব রচিত আইন-কানুনকে অস্বীকার করে। কারণ তা ইসলামী আইনের বিরোধী ও পরিপন্থী। আর আল্লাহর কিতাবকে জীবন ও রাষ্ট্র-সংবিধান রূপে মেনে নিতে সকলকে আহবান করে -যে কিতাবকে আল্লাহ মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-সমৃদ্ধির জন্য অবতীর্ণ করেছেন। আর তিনিই অধিক জানেন, কি তাদের জন্য কল্যাণকর। সেই কুরআন অপরিবর্তনীয়। যার বিধান কোন কালেও পরিবর্তিত হবে না এবং যুগের বিবর্তনে তার ক্রমবিকাশও ঘটবে না। নিশ্চিত ভাবে সারা বিশ্বের এবং বিশেষ করে মুসলিম-বিশ্বের দুর্গতি, বিভিন্ন কষ্ট, লাঞ্ছনা এবং অবজ্ঞার সম্মুখীন হওয়ার একমাত্র কারণ হল আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নাহ দ্বারা জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা ত্যাগ করা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রগতভাবে ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশের প্রতি প্রত্যাবর্তন ছাড়া মুসলিমদের কোন ইজ্জত ও শক্তি ফিরে আসতে পারে না। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না -যে পর্যন্ত না তারা নিজের অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। (সূরা রা'দ ১১ আয়াত)

১২। ফির্কাহ নাজিয়াহ সকল মুসলিমকে আল্লাহর পথে জিহাদের দিকে আহ্বান করে। আর জিহাদ প্রত্যেক মুসলিমের উপর তার শক্তি ও সামর্থ্যানুযায়ী ওয়াজেব। এই জিহাদ বিভিন্ন মাধ্যমে হয়ে থাকেঃ

(ক) রসনা ও কলম দ্বারা জিহাদঃ মুসলিম ও অমুসলিমকে সঠিক ও বিশুদ্ধ ইসলাম এবং সেই শিকমুক্ত তওহীদ বরণ এবং শক্তভাবে ধারণ করার প্রতি আহবান করা, যে শির্ক বহু মুসলিম দেশেই প্রসার লাভ করেছে। যে বিষয়ে রসূল (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, তা মুসলিমদের মাঝে আপতিত। হবে। তিনি বলেছেন, “কিয়ামত আসবে না যে পর্যন্ত না আমার উম্মতের। কিছু সম্প্রদায় মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে এবং আমার উম্মতের কিছু সম্প্রদায় মূর্তিপূজা করবে।” (হাদীসটি সহীহ, এটিকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন এবং এর মর্মার্থ নিয়ে একটি হাদীস মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে।)

(খ) অর্থ দ্বারা জিহাদঃ ইসলাম প্রচার করা ও ইসলামের প্রতি সঠিকভাবে আহবানকারী বই-পুস্তক ছাপানোর উপর অর্থ ব্যয় করে, নও মুসলিম এবং দুর্বলশ্রেণীর মুসলিম -যাদের মনকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করা প্রয়োজন - তাদের মাঝে বন্টন করে এবং মুজাহেদীনদের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র, যুদ্ধ-সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্র ইত্যাদি নির্মাণ ও ক্রয় করার উপর খরচ করে এই জিহাদ হয়।

(গ) প্রাণ দ্বারা জিহাদঃ ইসলামের বিজয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে লড়াই লড়ে এই জিহাদ হয়, যাতে আল্লাহর বাণীই সমুন্নত আর কাফেরদের। বাণী ভুলুণ্ঠিত হয়। জিহাদের এই প্রকারগুলির প্রতি ইঙ্গিত করে রসূলে করীম (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের অর্থ, প্রাণ এবং জিহ্বা দ্বারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর।” (হাদীসটি সহীহ, এটিকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।)।

আল্লাহর পথে জিহাদের শরয়ী মান ও নির্দেশ কয়েক প্রকারঃ

১। ফরযে আইন (যা ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকের উপর ফরয)। এই মান তখন হয় যখন কোন মুসলিম দেশকে শত্রুপক্ষ আক্রমণ ও গ্রাস করে। যেমন- ফিলিস্তীন (প্যালেষ্টাইন); যাকে দুষ্কৃতী ইয়াহুদীরা জবরদখল করে নিজেদের করায়ত্ত করে ফেলেছে। সুতরাং যথাসাধ্য জান ও মাল ব্যয় করে ঐ দেশ হতে ইয়াহুদীকে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত এবং মসজিদে আকসাকে মুসলিমদের প্রতি ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত সকল সামর্থ্যবান মুসলমান গোনাহগার থাকবে।

২ ফরযে কিফায়াহ, যথেষ্ট পরিমাণে কিছু লোক ঐ কর্তব্য পালন করলে অবশিষ্ট মুসলিমদের উপর তা আর ফরয থাকে না। সারা বিশ্বে ইসলামী দাওয়াত পৌছে দেওয়ার পথে এই জিহাদ সম্পন্ন হয়, যাতে সকল রাষ্ট্র ইসলামকেই রাষ্ট্রীয় সংবিধান বলে মেনে নেয়। আর যে ব্যক্তি এই দাওয়াতকে প্রতিহত করার পথে খাড়া হবে তাকেও পরাভূত করার উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা হবে যাতে দাওয়াত তার প্রবাহ পথে গতিশীল থাকে।

 ফির্কাহ নাজিয়াহর নিদর্শন

১। ফির্কাহ নাজিয়াহ মানুষের মধ্যে (প্রবাসীর মত অসহায়) মুষ্টিমেয়। যাদের জন্য আল্লাহর রসূল (সা.) দুআ করে বলেছেন, “শুভ সংবাদ ঐ (প্রবাসীর মত অসহায়) মুষ্টিমেয় লোকেদের জন্য; যারা বহু অসৎ লোকের মাঝে অল্পসংখ্যক সৎলোক। তাদের অনুগত লোকের চেয়ে অবাধ্য লোকের সংখ্যা অধিক।” (সহীহ, এটিকে আহমদ বর্ণনা করেছেন।)

এই দলের অনুসারীদের সম্পর্কে কুরআন কারীম সংবাদ দিয়েছে, এদের প্রশংসা করে কুরআন বলে,

وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ

অর্থাৎ, আমার বান্দাগণের মধ্যে অল্পসংখ্যকই লোক কৃতজ্ঞ। (সূরা সাবা ১৩ আয়াত)

২। ফির্কাহ নাজিয়াহর শত্রু বহু মানুষ। লোকেরা তাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়। তাদেরকে মন্দনাম ও খেতাবে অভিহিত করে থাকে। অবশ্য এ বিষয়ে তাদের আদর্শ ও নমুনা ছিলেন আম্বিয়াগণ; যাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا

(অর্থাৎ, এবং এরপর প্রত্যেক নবী (সা.) র জন্য শয়তান মানব ও দানবকে শত্রু করেছি যারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে ---। (সূরা আনআম ১১২ আয়াত)

আল্লাহর রসূল (সা.) যখন তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট তওহীদের দাওয়াত পেশ করলেন তখন তারা তাকে বলেছিল, 'মিথুক যাদুকর। অথচ এর পূর্বে তারা তাঁকে ‘সত্যবাদী আমানতদার’ বলে আখ্যা করত।

৩। শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (সউদী আরবের প্রধান মুফতী) ফির্কাহ নাজিয়াহ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন, “সালাফীগণই ফির্কাহ নাজিয়াহ; এবং তারা যারা সলফে সালেহ (রসূল ও সাহাবা)র মতাদর্শে চলে।

এগুলি ফির্কাহ নাজিয়াহর অল্প কিছু নীতি ও নিদর্শন। এবারে এই পুস্তিকার আগামী অধ্যায়গুলিতে ফির্কাহ নাজিয়াহর আকীদা ও বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করব; যে ফির্কাহর আর এক নাম ‘তায়েফাহ মনসূরাহ’ (সাহায্য প্রাপ্ত দল)। যাতে আমরা সকলে তার আকীদায় বিশ্বাসী হতে পারি। ইন শাআল্লাহ।

 সাহায্যপ্রাপ্ত দল কোনটি?

১। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “সর্বকালে আমার উম্মতের একটি দল হকের সাথে বিজয়ী থাকবে, তাদেরকে যারা উপেক্ষা করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত) এসে উপস্থিত হবে।”(মুসলিম)

২। তিনি আরো বলেন, “শামবাসী অসৎ হয়ে গেলে তোমাদের মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। আর চিরকালের জন্য আমার উম্মতের একটি দল সাহায্য প্রাপ্ত থাকবে, কিয়ামত কায়েম হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে উপেক্ষাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।” (সহীহ, মুসনাদে আহমদ)

৩। ইবনুল মুবারক বলেন, 'আমার মতে তারা হলেন আসহাবুল হাদীস।”

৪। ইমাম বুখারী বলেন, আলী ইবনুল মাদানী বলেছেন, তাঁরা হলেন আসহাবুল হাদীস।”

৫। আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, 'এই সাহায্যপ্রাপ্ত দলটি যদি আসহাবুল হাদীস না হয় তবে জানি না তারা কারা ?”

৬। আহলে হাদীসরাই যেহেতু সুন্নাহ এবং তার আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ের অধ্যয়নে বিশেষজ্ঞ তাই তারাই সকল মানুষের চেয়ে তাদের নবী (সা.)-এর সুন্নাহ, আদর্শ, পথনির্দেশ, চরিত্র, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং এর সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে।

৭। ইমাম শাফেয়ী ইমাম আহমাদকে সম্বোধন করে বলেন, আপনারা আমার চেয়ে অধিক হাদীস জানেন। অতএব আপনাদের নিকট শুদ্ধভাবে কোন হাদীস এলে সে বিষয়ে আমাকে খবর দেবেন, আমি তা সংগ্রহের জন্য যাত্রা করব -চাহে তা হিজায, কুফা অথবা বসরায় হোক।

সুতরাং আহলে হাদীস আল্লাহ আমাদের হাশর তাদের সহিত করেন - কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের পক্ষপাতিত্ব করে না -তাতে সে ব্যক্তি যতই শীর্ষস্থানীয় এবং সম্মানাই হন না কেন। পক্ষপাতিত্ব করে শুধু মুহাম্মাদ এর। পক্ষান্তরে অন্যান্য লোকেরা যারা আহলে হাদীস ও হাদীসের উপর আমলে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত নয়, তারা তাদের ইমামগণের উক্তির পক্ষপাতিত্ব করে -অথচ এমনটি করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের পক্ষপাতিত্ব করে থাকে; যেমন আহলে হাদীসগণ তাদের নবী (সা.) এর উক্তির পক্ষপাতিত্ব করে। সুতরাং বিস্ময়ের কিছু নয় যে, তারাই হল সাহায্য প্রাপ্ত এবং মুক্তি প্রাপ্ত দল বা জামাআত।

৮। খতীব বাগদাদী তার শারাফু আসহাবিল হাদীস (আহলে হাদীসের মর্যাদা) নামক গ্রন্থে বলেন, 'রায় ওয়ালা’ (মনগড়া মতকে প্রাধান্যদাতা) যদি ফলপ্রসু ইলম অন্বেষণে ব্যাপৃত হত এবং বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের রসূলের সুন্নাহসমূহ অনুসন্ধান করত, তবে সে সেই জিনিস অর্জন করতে পারত যা অন্যান্য থেকে তাকে অমুখাপেক্ষী করত। যেহেতু হাদীসে রয়েছে। তওহীদের মৌলনীতি সমূহের পরিজ্ঞান, আগত বিভিন্নমুখী অঙ্গীকার ও তিরস্কারের বিবৃতি, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের গুণাবলী, জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি বিষয়ক সংবাদ; তাতে সংযমী ও দুষ্কৃতীদের জন্য আল্লাহ কি প্রস্তুত রেখেছেন তার খবর এবং আল্লাহ পৃথিবীসমুহে ও আকাশমন্ডলীতে কি সৃষ্টি করেছেন তারও খবর।

আর হাদীসে রয়েছে আম্বিয়াগণের কাহিনী, যাহেদ (সংসার-বিরাগী) ও আওলিয়াগণের বৃত্তান্ত, বাশ্মীদের ওয়ায, ফকীহগণের উক্তি, রসূলের খুতবা এবং তার মু’জিযা (অলৌকিক ঘটনাবলী)। এতে রয়েছে কুরআন আযীম এবং তাতে উল্লেখিত মহাসংবাদ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশের ব্যাখ্যা ও সাহাবাদের নিকট হতে আহকামে (কর্মাকর্মে) সংরক্ষিত তাঁদের বাণী।

আল্লাহ আহলে হাদীসকে শরীয়তের রুকন (স্তম্ভ) করেছেন এবং তাদের দ্বারা প্রত্যেক নিকৃষ্ট বিদআতকে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং তারা সৃষ্টিজগতে আল্লাহর আমানতদার নবী (সা.) ও তার উম্মতের মাঝে মাধ্যম, তাঁর গ্রন্থের মূল পাঠ সংরক্ষণে প্রয়াসী। তাদের আলোক প্রদীপ্ত, তাদের মর্যাদা সমুন্নত, আসহাবে হাদীস ব্যতীত প্রত্যেক দলই ঐ সমস্ত খেয়াল খুশীর আশ্রয় নেয়, যার প্রতি তারা রুজু করে এবং যে রায়কে পছন্দ ও ভালো মনে করে, আর তার উপর তারা নির্বিচল থাকে।

কিতাব (কুরআন) তাদের সরঞ্জাম ও হাতিয়ার, সুন্নাহ তাদের হুজ্জত (অকাট্য দলীল), রসূল (সা.) তাদের স্বীয় দল; তার প্রতিই তাদের সম্বন্ধ। তারা রায়ের (মনগড়া মতের) প্রতি দৃকপাত করে না। যারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেন এবং যারা তাদের প্রতি শত্রুতা করে আল্লাহ তাদেরকে উপেক্ষা করেন।

হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে আহলে হাদীসের দলভুক্ত কর। হাদীসের উপর আমল, তার অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী আমলকারীদের সহায়তা করার তওফীক দান কর। (আমীন)

 তওহীদ ও তার প্রকরণ

যে ইবাদত করার জন্য আল্লাহ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই ইবাদতে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় জানা ও মানার নাম তওহীদ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

অর্থাৎ, আমার ইবাদতের জন্যই আমি মানুষ এবং জিনকে সৃষ্টি করেছি।(১) (সূরা যারিয়াত ৫৬ আয়াত) (অর্থাৎ আমি ওদেরকে কেবল এই জন্যই সৃষ্টি করেছি। যে, ওরা ইবাদতের যোগ্য হিসাবে আমাকেই একক বলে মানবে এবং দুআ ও প্রার্থনার স্থল হিসাবে আমাকেই অদ্বিতীয় স্বীকার করবে।)

কুরআন কারীম হতে সংগৃহীত তওহীদের প্রকরণ নিম্নরূপঃ

১৷ তওহীদুর রব্ব (প্রতিপালক বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল এই কথার স্বীকার যে, আল্লাহই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। অবশ্য একথা কাফেরদলও স্বীকার করেছে; কিন্তু এ স্বীকারোক্তি তাদেরকে ইসলামে প্রবিষ্ট করেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

অর্থাৎ, যদি তুমি ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর যে, কে ওদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে অবশ্যই ওরা বলবে, 'আল্লাহ।' (সূরা যুখরুফ ৮৭ আয়াত)

বর্তমান যুগে কমিউনিষ্টরা প্রতিপালক (আল্লাহর) অস্তিত্বকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করে, তাই তারা জাহেলিয়াতের কাফেরদের চেয়েও বড় কাফের।

২। তওহীদুল ইলাহ (উপাস্য বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল সকল। প্রকার বিধিবদ্ধ ইবাদত -যেমন, দুআ ও প্রার্থনা, সাহায্য প্রার্থনা, তওয়াফ, যবেহ, নযর ইত্যাদিতে আল্লাহকে একক মান্য করা। এই প্রকার তওহীদকেই কাফের দল অস্বীকার করেছিল, এবং এই তওহীদ নিয়েই নুহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সমস্ত রসূল ও তাদের উম্মতের মাঝে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ ছিল। কুরআন কারীমের অধিকাংশ সূরাসমূহে এই তওহীদ এবং একমাত্র আল্লাহকেই (বিপদে-আপদে) ডাকা ও তাঁরই নিকট প্রার্থনা করার উপর মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। যেমন সূরা ফাতেহায় আমরা পড়ে থাকি,

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

অর্থাৎ, আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, তাই তোমাকেই কেবল আহবান করি এবং তুমি ব্যতীত আর কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি না।

একমাত্র আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, কুরআন দ্বারা মীমাংসা ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরীয়তের নিকটেই নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারপ্রার্থী হওয়া, এ সব কিছু তওহীদুল ইলাহের শামীল। আর এর প্রত্যেকটাই আল্লাহর এই বাণীর আওতাভুক্ত যাতে তিনি বলেন,

إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي

অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি আল্লাহ, আমি ভিন্ন আর কোন (সত্য) উপাস্য নেই, সুতরাং তুমি আমারই উপাসনা কর। (সূরা ত্বহা ১৪ আয়াত)

৩৷ তওহীদুল আসমা-ই অসিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলী বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল, কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত সেই সমস্ত সিফাত বা গুণ, যার দ্বারা আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা তার রসূল (সা.) তার জন্য বর্ণনা করেছেন তা বাস্তব ও প্রকৃত ভেবে, কোন প্রকারে তার অপব্যাখ্যা না করে, কোন উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত কল্পনা না করে এবং তার প্রকৃতার্থ ‘জানি না’ বলে সে বিষয়ে আল্লাহকে ভারার্পণ না করে ঈমান ও প্রত্যয় রাখা। যেমন আল্লাহর আরশে আরোহণ, রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর আকাশে তাঁর অবতরণ, তার হস্ত, তার আগমন ইত্যাদি গুণ। আমরা এ সবের সেই রূপ ব্যাখ্যা করব যে রূপ সলফ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। যেমন তাবেয়ীন কর্তৃক তাঁর সমারূঢ় হওয়ার ব্যাখ্যা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত; আর তা এই যে, তিনি সারা সৃষ্টির উর্ধে আরশের উপরে সমারূঢ়। যেমনঃ তার মহিমা ও মহত্বের উপযুক্ত (এবং তা কারো সদৃশ নয়)। আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

অর্থাৎ, তার সদৃশ কোন কিছুই নেই এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরা ১১ আয়াত)

ক। তা'বীলঃ আয়াত ও সহীহ হাদীসের স্পষ্ট অর্থকে ভিন্ন কোন অসঙ্গত ও বাতিল অর্থে পরিবর্তন করাকে বলা হয়। যেমন, আল্লাহ আরশে সমারূঢ় আছেন। এর অর্থ এই করা যে, তিনি সার্বভৌম ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের অধিকারী।”

খা। তা’ত্বীল (অর্থহীন, নিস্ক্রিয় বা বিরহিতকরণ): আল্লাহর গুণাবলীকে। অস্বীকার করা এবং তাঁকে (ঐ সমস্ত) গুণবিহীন ভাবাকে বলে। যেমন, আল্লাহর আকাশের উর্ধে অবস্থানকে কিছু ভ্রষ্ট ফির্কাহ অস্বীকার করে ও বলে, 'আল্লাহ সকল স্থানেই আছেন!’ (বা আল্লাহ মুমিনের হৃদয়ে আছেন।)

গ। তাকয়ীফ (কেমনত্ব বর্ণনা করা): আল্লাহর গুণাবলীর কেমনত্ব বর্ণনা করাকে বলে। যেমন বলা, তার রকমত্ব (হস্ত-পদ প্রভৃতি) এই রূপ।” সুতরাং আরশের উপর আল্লাহর আরোহণ করা তার কোন সৃষ্টির আরোহন করার মত নয় এবং তাঁর আরোহণ করার কেমনত্ব তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না।

ঘ। তামষীল (নমুনা বা দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা): সৃষ্টির গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহর গুণাবলীর দৃষ্টান্ত দেওয়া অথবা তার গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর সহিত তুলনা করা। সুতরাং এ বলা বৈধ নয় যে, আমাদের অবতরণ করার মত আল্লাহ আকাশের প্রতি অবতরণ করেন। অবতরণের হাদীসটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহর গুণকে সৃষ্টির গুণের সদৃশ ভাবার কথা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহর প্রতি আরোপ করা এক মিথ্যা অপবাদ। যেহেতু আমরা তার গ্রন্থাবলীতে একথার সত্যতার প্রমাণ পাইনি। বরং তিনি এই তাশবীহ ও তামষীলের (আল্লাহর গুণাবলী সৃষ্টির অনুরূপ হওয়ার কথা) খণ্ডন করেছেন এটাই আমরা পেয়েছি।

ঙ। তাফীয’ (ভারার্পণ করা): সলফগণ আল্লাহর গুণাবলীর কেমনত্ব বিষয়ের জ্ঞান তার প্রতি সমর্পণ করেন এবং ঐ গুণাবলীর অর্থ বিষয়ক জ্ঞান তাঁর প্রতি সমর্পণ করেন না (যেহেতু সে সবের অর্থ তাদের নিকট স্পষ্ট ও বিদিত এবং কেমনত্ব অবিদিত)। উদাহরণ স্বরূপ (استوى) ইসতিওয়া’ (আরোহণ করা) এর অর্থ কোন কিছুর ঊর্ধে অবস্থান বা আরোহণ করা যার কেমনত্ব আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না।

[১]. অত্র আয়াতটি সেই ব্যক্তির বিশ্বাসকে খন্ডন করে। যে মনে করে যে, কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের জন্যই সারা বিশ্ব সৃজিত হয়েছে।

 লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ এর অর্থ

(لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ) এর অর্থ আল্লাহ ব্যতীত কেউ সত্য মাবুদ (উপাস্য) নেই। এতে রয়েছে সমস্ত গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত সকল সৃষ্টি) হতে উপাস্যতার খন্ডন এবং তা কেবল আল্লাহরই জন্য প্রতিপাদন।

১- আল্লাহ তাআলা বলেন, (فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ) অর্থাৎ, সুতরাং তুমি জান যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই।” (সূরা মুহাম্মদ ১৯ আয়াত)

অতএব এই কলেমার অর্থ জানা ওয়াজেব এবং তা ইসলামের সমস্ত রুকন (স্তম্ভের) অগ্রে হওয়া বাঞ্ছনীয়।

২। মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ-চিত্তে (ইখলাসের সহিত) “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

আর মুখলিস (বিশুদ্ধ-চিত্ত) সেই হতে পারে যে তার অর্থ বুঝে, তার দাবী অনুযায়ী কর্ম (আমল) সম্পাদন করে এবং অন্যান্য আমলের পূর্বে তার প্রতি মানুষকে আহ্বান করে (দাওয়াত দেয়)। যেহেতু এতেই রয়েছে সেই তওহীদ যার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আল্লাহ বিশ্ব রচনা করেছেন।

৩। রসূল (সা.)-এর পিতৃব্য আবুতালেবের যখন মরণকাল উপস্থিত হয়, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন, 'হে পিতৃব্য! আপনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন - এটা এমন এক কলেমা যাকে আল্লাহর নিকট আপনার (মুক্তির) জন্য দলীল স্বরুপ পেশ করব। কিন্তু তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করলেন। (বুখারী ও মুসলিম)

৪। রসূল (সা.) তের বছর মক্কায় অবস্থান করে আরববাসীদের এই বলে আহ্বান করেছেন যে, তোমরা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ সত্য উপাস্য নেই) বল। কিন্তু তারা বলেছিল, একটি মাত্র উপাস্য!? এরূপ তো আমরা কক্ষনো শুনিনি।

কারণ আরবরা এর অর্থ বুঝেছিল। আর এও বুঝেছিল যে, এই বাণী যে বলবে, সে আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কাউকে আহবান করতে পারে না। তাই তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং বলেওনি। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ * وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُو آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ * بَلْ جَاءَ بِالْحَقِّ وَصَدَّقَ الْمُرْسَلِينَ

অর্থাৎ, ওদের নিকট আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই’ বলা হলে ওরা অহংকারে অগ্রাহ্য করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে বর্জন করব? বরং (মুহাম্মাদ) তো সত্য নিয়ে এসেছিল এবং সমস্ত রসূলের সত্যতা স্বীকার করেছিল। (সূরা সাফফাত ৩৫-৩৭ আয়াত)।

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোন। সত্য উপাস্য নেই) বলবে এবং আল্লাহ ব্যতীত পূজ্যমান যাবতীয় ব্যক্তি ও বস্তুকে অস্বীকার ও অমান্য করবে তার জান ও মাল অবৈধ হয়ে যাবে।” (মুসলিম)

হাদীস শরীফটির মমার্থ এই যে, সাক্ষ্যবাণী উচ্চারণ করণের সাথে সাথে প্রত্যেক গায়রুল্লাহর ইবাদত -যেমন মৃত কবরবাসীদের নিকট কিছু প্রার্থনা ইত্যাদি- প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করা একান্ত জরুরী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, কিছু মুসলিম ঐ কলেমা তাদের মুখে আবৃত্তি করে। থাকে অথচ তাদের কর্মকান্ড ও আমল এবং গায়রুল্লাহকে ডাকা ও তার নিকট প্রার্থনা দ্বারা তারা ওর অর্থের বিরুদ্ধাচরণ করে!

৫। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তওহীদ ও ইসলামের মূল ভিত্তি এবং জীবনের এক পুর্ণাঙ্গ নীতি; যা সকল প্রকার ইবাদত ও উপাসনাকে কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। আর তা তখন সম্ভব হয় যখন মুসলিম আল্লাহরই বিনীত আজ্ঞানুবর্তী হয়, একমাত্র তাঁকেই আহবান করে, তারই নিকট সবকিছু প্রার্থনা করে এবং সকল সংবিধানকে উপেক্ষা করে কেবল শরীয়তের সংবিধান ও কানুনকে বিচার-ভার সমর্পণ করে ও তারই মীমাংসাকে সাদরে মেনে নেয়।।

৬। ইবনে রজব বলেন, 'ইলাহ (উপাস্য) তিনিই, যার সম্ভ্রম ও সম্মানে, ভক্তি ও ভয়ে, যার অনুগ্রহের আশায়, যার উপর ভরসা রেখে, যার নিকট যাচনা করে ও যাকে আহ্বান করে আনুগত্য করা হয় এবং বিরুদ্ধাচরণ না করা হয়। আর এ সমস্ত একমাত্র আল্লাহ ভিন্ন আর কারো জন্য উপযুক্ত নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন সৃষ্টিকে উপাস্যের বৈশিষ্ট্য ঐ বিষয়গুলির মধ্যে যে কোন একটিতেও (আল্লাহর শরীক করবে তার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার বিশুদ্ধচিত্ততায় (ইখলাসে) ত্রুটি থেকে যাবে এবং তার মধ্যে সৃষ্টির দাসত্ব স্থানলাভ করবে। যে পরিমাণে ঐ শির্ক বৃদ্ধি করবে সেই পরিমাণে ঐ ত্রুটি এবং দাসত্ব ও বৃদ্ধি পেতে থাকবে।”

৭ কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তার পাঠকারীকে উপকৃত করবে; যদি সে শির্ক দ্বারা তা নষ্ট না করে। তা করলে কলেমা সেই ব্যক্তির জন্য ঐ ওযুর মতই হবে যা অপবিত্রতা (বাতকর্ম ইত্যাদির কারণে নষ্ট হয়ে যায়।

মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তির (জীবনে) শেষ কথা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে সে জান্নাত লাভ করবে।” (হাসান, হাকেম বর্ণনা করেছেন।

 ‘মুহাম্মাদূর রসূলুল্লাহ’ এর অর্থ

১। (محمد رسول الله) মুহাম্মাদূর রসূলুল্লাহ’র অর্থ এই বিশ্বাস যে, তিনি আল্লাহর তরফ হতে প্রেরিত দূত ও রসূল। সুতরাং তিনি আমাদেরকে যে খবর দেন তা বিশ্বাস ও সত্যজ্ঞান করব, তিনি আমাদেরকে যা আদেশ করেন তাতে আমরা তার আনুগত্য করব। তিনি আমাদেরকে যা নিষেধ করেন ও বাধা দেন তা আমরা বর্জন করব এবং তিনি যা বিধেয় করেছেন কেবল সেই অনুসারেই আমরা আল্লাহর ইবাদত করব।

শায়খ আবুল হাসান নদবী ‘নবুওঅত’ গ্রন্থে বলেন, 'প্রত্যেক যুগ ও প্রত্যেক পরিবেশে আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালামগ)ণের সর্বপ্রথম দাওয়াত এবং সর্ববৃহৎ লক্ষ্য ছিল আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধে আকীদাহ ও বিশ্বাসের সংশুদ্ধি, আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে সম্পর্ক যথার্থকরণ, দ্বীন ও আনুগত্যকে আল্লাহরই জন্য বিশুদ্ধকরণের প্রতি আহ্বান, কেবলমাত্র আল্লাহরই জন্য ইবাদত ও উপাসনাকরণ, এবং (এই কথার জ্ঞানদান যে,) তিনিই একমাত্র উপকারী ও অপকারী, তিনিই ইবাদত, দুআ, শরণ প্রার্থনা, যবেহ ইত্যাদির একক অধিকারী। তাদের দাওয়াতী সংগ্রাম তাদের যুগে সেই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত ছিল যা মূর্তি, ছবি এবং জীবিত ও মৃত সাধু-সজ্জনদের উপাসনা রূপে প্রচলিত ছিল।”

২। এই আমাদের রসূল, যাকে সম্বোধন করে তার প্রভু বলেন,

قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

অর্থাৎ, বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভালোমন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের (গায়বের) খবর জানতাম, তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করে নিতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী মাত্র।' (সূরা আরাফ ১৮৮ আয়াত)

রসূল (সা.) বলেন, “তোমরা আমার প্রশংসায় অতিরঞ্জন করো না; যেমন খ্রিষ্টানরা মারয়্যাম-তনয়ের প্রশংসায় অতিরঞ্জন করেছিল। আমি তো একজন। বান্দা মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূলই বলো।”

উক্ত হাদীসে (اطراء) শব্দের অর্থ হল, প্রশংসায় (না’তে) বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করা। অতএব আমরা তার প্রশংসায় সীমালংঘন করব না এবং আল্লাহকে ছেড়ে তাকে উপাস্য বলে আহবান করব না; যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা বিন মারয়্যামের ব্যাপারে মাত্রাধিক প্রশংসায় অতিরঞ্জন করে (এবং তাঁকে মাবুদের আসনে বসিয়েছিল) শির্কে আপতিত হয়েছিল। তাই আমাদেরকে আমাদের রসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন কেবল বলি, মুহাম্মাদ আল্লাহর দাস এবং তার প্রেরিত দূত।

৩। একমাত্র আল্লাহকেই (বিপদে-আপদে) আহবান করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে আহবান না করা; যদিও তিনি রসূল হন অথবা কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত অলী। এই নির্দেশে রসূল (সা.) এ-এর আনুগত্য করলে তার মহব্বত ও প্রেম প্রকাশ হয়। তিনি বলেন, “যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য ভিক্ষা করবে তখন আল্লাহর নিকটেই সাহায্য ভিক্ষা করো।” (তিরমিযী, তিনি এটিকে হাসান-সহীহ বলেছেন।)

রসূল (সা.) কোন উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তায় পড়লে বলতেন, “হে চিরঞ্জীব! হে অবিনশ্বর! আমি তোমার রহমতের অসীলায় (তোমার নিকট) সাহায্যের আবেদন করছি।” (তিরমিযী, হাদীসটি হাসান) আল্লাহ কবির প্রতি সদয় হন। তিনি বলেছেন,

‘দূর হয়ে যাক বিপদ মোদের আল্লাহর কাছেই চাই।

আল্লাহ ছাড়া বিপত্তারণ আর তো কেহ নাই।”

 “আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।”

১। আরবী সাহিত্যের উলামাগণ উল্লেখ করেন যে, উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা (না’বুদু ও নাসতাঈন) ক্রিয়ার পূর্বে (ইয়্যা-কা) কর্মকারককে অগ্রে উল্লেখ করেছেন যাতে ইবাদত কেবল তারই জন্য ও সাহায্য প্রার্থনা কেবল তারই নিকট নিরূপিত হয় এবং তা কেবল তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়।

২। অত্র আয়াত শরীফটি - যা মুসলিম নামাযে ও তার বাইরে প্রত্যহ বহুবার আবৃত্তি করে থাকে তা -সূরা ফাতিহার সারাংশ এবং সূরা ফাতিহা সমগ্র কুরআন মাজীদের সারাংশ ও নির্যাস।

৩। অত্র আয়াতে ইবাদত কথাটি ব্যাপক। যাতে সর্বপ্রকার ইবাদত ও উপাসনা যেমন নামায, ন্যর, যবেহ এবং বিশেষ করে দুআকে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “দুআই হচ্ছে ইবাদত।” (তিরমিযী, আর তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন)।

সুতরাং নামায যেমন এক প্রকার ইবাদত; যা কোন রসূল অথবা ওলীর জন্য নিবেদন করা বৈধ নয়, তেমনি দুআ (প্রার্থনা করা ও বিপদে ফরিয়াদ করা)ও এক প্রকার ইবাদত যা গায়রুল্লাহর জন্য নিবেদন করা অবৈধ। বরং তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। তিনি বলেন,

قُلْ إِنَّمَا أَدْعُو رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِهِ أَحَدًا

অর্থাৎ, বল, 'আমি আমার প্রতিপালককেই কেবল ডাকি এবং তার সহিত অন্য কাউকেও শরীক করি না।' (সূরা জিন ২০ আয়াত)

৪। প্রিয় রসূল (সা.) বলেন, “মাছের উদরে অবস্থানকালে যুননুন (ইউনূস (আঃ) যে দুআ করেছিলেন সেই দুআ হল,

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

(অর্থাৎ, তুমি ব্যতীত কেউ সত্য উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র। আমি নিশ্চয় অত্যাচারীদের দলভুক্ত।) কোন মুসলিম যদি এই দুআ দ্বারা কখনো প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ অবশ্যই তা মঞ্জুর করেন। (হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী এতে একমত হয়েছেন।

কেবল আল্লাহরই নিকট সাহায্য চাও

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও। এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী এবং তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।)

১। ইমাম নববী ও হাইতামী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় যা বলেন তার সারাংশ এই যে, যখন তুমি তোমার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কোন বিষয়ে সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও। বিশেষ করে সেই সকল বিষয়ে আল্লাহর নিকট সাহায্য-ভিক্ষা কর, যে সব বিষয়ে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ সাহায্য করতে সক্ষম নয়। যেমন, রোগ-নিরাময়, রুজী ও হেদায়াত প্রার্থনা প্রভৃতি; যে সব দান কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ, আর যদি আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দান করেন, তবে তিনি ব্যতীত আর কেউ তার মোচনকারী নেই। (সূরা আনআম ১৭ আয়াত)

২। যে ব্যক্তি হুজ্জত ও দলীল চায় তার জন্য কুরআন যথেষ্ট, যে ব্যক্তি রক্ষা ও সাহায্যকারী চায় তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, যে ব্যক্তি উপদেষ্টা চায় তার জন্য মৃত্যুই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তির জন্য এ সবের কিছুই যথেষ্ট নয়, তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন, (أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ) অর্থাৎ-আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? (সূরা যুমার ৩৬ আয়াত)

৩। শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী আল-ফাতহুর রাব্বানী’তে বলেন, “আল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা কর এবং তিনি ব্যতীত অন্যের নিকট প্রার্থনা করো

ও কেবল আল্লাহর নিকটেই সাহায্য চাও এবং তিনি ব্যতীত আর কারো নিকট সাহায্য চেয়ো না। ধিক তোমাকে! তুমি কোন মুখ নিয়ে কাল তার সহিত সাক্ষাৎ করবে, অথচ দুনিয়াতে তুমি তার বিরুদ্ধে কলহে লিপ্ত রয়েছ, তার থেকে বিমুখ রয়েছ, তার সৃষ্টির মুখাপেক্ষী হচ্ছ, তার সহিত তাদেরকে শরীক (শির্ক) করছ, তাদের নিকট নিজের প্রয়োজন ভিক্ষা করছ এবং সংকটাপন্ন কর্মসমুহে তাদের উপর ভরসা করছ?! তোমাদের এবং আল্লাহর মাঝে সমস্ত মাধ্যম ও অসীলা তুলে ফেল; কারণ ওদের সহিত তোমাদের অবস্থান (বা ওদের পিছন ধরে থাকা) মুখতা। একমাত্র ‘হক’ (সত্য) আল্লাহ আযযা অজাল্ল ব্যতীত আর কারো জন্য কোন রাজত্ব, কোন আধিপত্য, কোন স্বনির্ভরতা, কোন সম্মান নেই। সৃষ্টিকে ছেড়ে স্রষ্টা হকে’র দিকে হয়ে যাও। (অর্থাৎ, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্য হতে কাউকে মাধ্যম না করেই সরাসরি তাকে ডেকে তার দিকে হয়ে যাও।)”

৪। বিধিসম্মত সাহায্য ভিক্ষা এই যে, নিজের বিপদ ও সংকট দূর করার জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া। আর অবৈধ শির্কী সাহায্য ভিক্ষা এই যে, বিপদ দূর করার জন্য গায়রুল্লাহ; যেমন, আম্বিয়া, মৃত অথবা জীবিত আওলিয়ার-নিকট সাহায্য চাওয়া। যেহেতু তারা ইষ্ট বা অনিষ্ট কিছুরই মালিক নন এবং তারা প্রার্থনা শুনতেও পান না। পক্ষান্তরে যদি শুনতেও পান তথাপিও তাঁরা আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারেন না। যেমন এ বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। (সূরা ফাত্রির ১৪ আয়াত দ্রঃ)

পরন্তু উপস্থিত জীবিত ব্যক্তিবর্গের নিকট তাদের সাধ্যভূক্ত কর্মে; যেমন, মসজিদ নির্মাণ, আর্থিক অনটন প্রভৃতিতে সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ

অর্থাৎ, তোমরা সৎ ও আল্লাহ-ভীতির কর্মে একে অন্যের সহায়তা কর। (সূরা মায়েদাহ ২ আয়াত)

আর মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভায়ের সাহায্যে থাকে।” (মুসলিম)

উপস্থিত জীবিত ব্যক্তির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার আরো দৃষ্টান্ত; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِي مِن شِيعَتِهِ عَلَى الَّذِي مِنْ عَدُوِّهِ

অর্থাৎ, মুসার দলের লোকটি ওর শত্ৰুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার (মুসার) সাহায্য প্রার্থনা করল। (সূরা কাসাস ১৫ আয়াত)

ইয়াজুজ ও মাজুজের ক্ষতি হতে বাঁচতে প্রাচীর নির্মাণকল্পে লোকদের নিকট যুল ক্বারনাইনের শ্রম চাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,

فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ

অর্থাৎ, (যুল ক্বারনাইন বলল,) ---সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য কর।' (সূরা কাহফ ৯৫ আয়াত)।

 দয়াময় (আল্লাহ) আরশে সমারূঢ়

বহু সংখ্যক আয়াত, হাদীস এবং সলফের উক্তি আল্লাহর সৃষ্টির উর্ধে থাকার কথা প্রমাণ করে।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

অর্থাৎ, তাঁর প্রতিই সৎবাক্য আরোহণ করে এবং সৎকর্মকে তিনি উখিত করেন। (সূরা ফাতুির ১০ আয়াত)

২। তিনি আরো বলেন,

ذِي الْمَعَارِجِ تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ

অর্থাৎ, ---যিনি সোপান-শ্রেণীর মালিক। ফিরিস্তা এবং রূহ তাঁর প্রতি ঊর্ধ্বগামী হবে---। (সূরা মাআরিজ ৩-৪ আয়াত)

৩। তিনি অন্যত্রে বলেন, (سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى) অর্থাৎ, তুমি তোমার সুউচ্চ প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর। (সূরা আ’লা ১ আয়াত)

৪। বুখারী (তার সহীহ গ্রন্থে) কিতাবুত তাওহীদে আবুল আলিয়াহ ও মুজাহিদ হতে (নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেনঃ (ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ) (অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি আরোহণ করেন) অর্থাৎ উর্ধে হন এবং উপরে উঠেন।

৫। আল্লাহ তাআলা বলেন, (الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ) অর্থাৎ, দয়াময় আরশে আরোহণ করলেন। (সূরা ত্বা-হা ৫ আয়াত)* এর অর্থও (তিনি আরশের) ঊর্ধ্বে আছেন এবং (তার উপরে) উঠেছেন; যেমন তফসীরে ত্বাবারীতে এ কথার উল্লেখ এসেছে।

৬। বিদায়ী হজ্জে আরাফার দিনে আল্লাহর রসূল (সা.) তার ভাষণে বলেন, “শুনো! আমি কি পৌছে দিলাম?” সকলে বলল, 'হ্যা। (অতঃপর) তিনি আকাশের দিকে অঙ্গুলী উত্তোলন করে এবং সকলের প্রতি তা নত করে বলেন, “হে আল্লাহ সাক্ষী থাকুন।” (মুসলিম)

৭। প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, “আল্লাহ সৃষ্টি সৃজন করার পুর্বে এক কিতাব লিখেছেন। (যাতে আছে) আমার ক্রোধ অপেক্ষা আমার করুণা অগ্রগামী।” সুতরাং তা তার নিকট আরশের উপর লিপিবদ্ধ রয়েছে।”

৮। “তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর না কি? অথচ আমি তার নিকট বিশ্বস্ত যিনি আকাশে আছেন। আমার নিকট সকাল ও সন্ধ্যায় আকাশের খবর । আসে।” (বুখারী ও মুসলিম)

৯। ইমাম আওযায়ী বলেন, বহু সংখ্যক তাবেঈন বর্তমান থাকা কালীন সময়েও আমরা বলতাম, “আল্লাহ জাল্লা যিকরুহ আরশের উপরে আছেন। তার যে সমস্ত সিফাত (গুণাবলী)র বর্ণনা সুন্নাহতে (হাদীসে) এসেছে আমরা। তাতে ঈমান (বিশ্বাস) রাখি। (এটিকে বাইহাক্বী সহীহ সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন, দেখুন ফতহুল বারী)।

১০। ইমাম শাফেয়ী বলেন, 'আল্লাহ তাআলা আকাশে আরশের উপর আছেন। যেভাবে ইচ্ছা তিনি সৃষ্টির নিকটবর্তী হন এবং আল্লাহ যেভাবে চান। পৃথিবীর আকাশের প্রতি অবতরণ করেন। (এটিকে হাকাব ‘আকীদাতুশ শাফেয়ী’তে বর্ণনা করেছেন।}

১১। ইমাম আবু হানীফাহ বলেন, যে ব্যক্তি বলে যে, জানি না আমার প্রতিপালক আকাশে আছেন নাকি পৃথিবীতে সে অবশ্যই কাফের হয়ে যায়। যেহেতু আল্লাহ বলেন, (الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ)। অর্থাৎ, “দয়াময় আরশে আরোহণ করলেন।” আর তার আরশ সপ্তাকাশের উপরে। আবার সে যদি বলে, তিনি আরশের উপরেই আছেন, কিন্তু বলে, জানি না যে, আরশ আকাশে আছে নাকি পৃথিবীতে’-তাহলেও সে কাফের। কারণ সে একথা অস্বীকার করে যে তিনি আকাশে আছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তার আকাশে থাকার কথা অস্বীকার করে সে অবশ্যই কাফের হয়ে যায়। যেহেতু আল্লাহ সকল সৃষ্টির উর্ধে আছেন এবং উপর দিকে মুখ করেই তাঁকে ডাকা হয় (দুআ করা হয়), নিচের দিকে মুখ করে নয়।' (শারহুল আকীদাতিত্ব তাহাবিয়্যাহ ৩১২ পৃঃ)

১২। আল্লাহ কিভাবে আরশে সমারূঢ়?’ -এ বিষয়ে ইমাম মালেক জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেছিলেন, 'আরোহণ করা বিদিত, এর কেমনত্ব অবিদিত, এর প্রতি ঈমান (বিশ্বাস) রাখা ওয়াজেব এবং এর কেমনত্ব প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা বিদআত। আর এই (প্রশ্নকারী) বিদআতীকে (আমার মজলিস থেকে) বের করে দাও।

১৩। (استوى) ইসতাওয়া (আরোহণ করেছেন) এর তফসীর ও ব্যাখ্যা (استولي) ‘ইসতাওলা’ (ক্ষমতাসীন বা আধিপত্য বিস্তার করেছেন) করা বৈধ নয়। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা সলফ কর্তৃক বর্ণিত হয়নি। আর তাদের নীতি ও পথ অধিকতম নিরাপদ, নিখুঁত, জ্ঞানগর্ভ, বলিষ্ট ও প্রজ্ঞাময়।

ইবনুল কাইয়েম আল-জাওযিয়্যাহ বলেন, “আল্লাহ ইয়াহুদকে (حطة) ‘হিত্তাহ’ বলতে আদেশ করেছিলেন, কিন্তু ইয়াহুদ তা বিকৃত করে (حنطة) হিনত্বাহ’ বলেছিল। আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন যে তিনি (استوي علي العرش) 'ইসতাওয়া আলাল আরশ' (আরশে আরোহণ করেন)। কিন্তু অপব্যাখ্যাকারীরা বলে, (استولي) ‘ইসতাওলা’ (ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করেন)! সুতরাং লক্ষ্য করুন, এদের বর্ধিত ل এর সহিত ইয়াহুদীদের বর্ধিত ن এর কি সুন্দর মিল রয়েছে!!” (এটিকে মুহাম্মাদ আল আমীন শানকীত্বী ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়্যাহ থেকে নকল করেছেন)।

* আরশে আরোহণ করার কথা কুরআনে ৭ বার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যা এ বিষয়ে গুরুত্ব নির্দেশ করে।

 তওহীদের গুরুত্ব

১। আল্লাহ বিশ্বজগৎ রচনা করেছেন তার ইবাদতের জন্য। তিনি বহু রসূল প্রেরণ করেছেন মানুষকে তার তওহীদ (একত্ববাদের) প্রতি আহবান করার জন্য। কুরআন কারীম তার অধিকাংশ সূরাসমূহে তওহীদের আকীদাহ বর্ণনায় যত্নবান। বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য শির্কের অপকারিতা বিবৃত করেছে, যে শির্ক ইহকালে মানুষের ধ্বংসের এবং পরকালে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হওয়ার কারণ।

২। সমস্ত রসূল প্রথমে তওহীদের দিকেই মানুষকে আহবান (দাওয়াত) করতে শুরু করেছেন; যে তওহীদ লোকমাঝে প্রচার ও তবলীগ করার জন্য আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

অর্থাৎ, আমি তোমার পুর্বে যে রসূলই প্রেরণ করেছি তার প্রতি এই প্রত্যাদেশই করেছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। সুতরাং তোমরা আমারই উপাসনা কর।” (সূরা আম্বিয়া ২৫ আয়াত)

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মক্কায় ২৩ বছর অবস্থান করে নিজ সম্প্রদায়কে আল্লাহর তওহীদ এবং সব কিছু ত্যাগ করে কেবল তাকেই ডাকা (ও কেবল তারই নিকট প্রার্থনা করা)র প্রতি আহবান করেন। তাঁর প্রতি আল্লাহর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ ছিল,

قُلْ إِنَّمَا أَدْعُو رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِهِ أَحَدًا

অর্থাৎ, বল, আমি কেবল আমার প্রতিপালককেই ডাকি এবং তার সহিত কাউকে শরীক করি না।' (সূরা জিন ২০ আয়াত)।

রসূল (সা.) তার অনুসারীবর্গকে শুরু ও শৈশব থেকেই তওহীদের উপর তরবিয়ত ও ট্রেনিং দিতে থাকলেন। তাই তো তিনি কিশোর পিতৃব্য-পুত্র আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস -কে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চেয়ো এবং যখন তুমি সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর নিকটেই সাহায্য প্রার্থনা করো।” (তিরমিযী)।

এই তওহীদই হল দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয় এবং তার বুনিয়াদ। যে। তওহীদ ব্যতিরেকে আল্লাহ অন্য কিছু কারো নিকট হতে গ্রহণ করবেন না।

৩। রসূল (সা.) নিজ সাহাবা ও সহচরবৃন্দকে শিখিয়ে ছিলেন যে, তারা যেন মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার সময় তওহীদকে সর্বাগ্রে পেশ করে। তাই মুআয (রাঃ)-কে ইয়ামান প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন, “তাদেরকে তোমার দাওয়াতের প্রথম পর্যায় যেন “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য মাবুদ নেই) এর সাক্ষ্যদান হয়।” অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, “(তোমার প্রথম দাওয়াত যেন) আল্লাহর তওহীদের প্রতি হয়।” (বুখারী ও মুসলিম)

৪। “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদূর রাসুলুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল বা দূত) এই বাণীর সাক্ষ্য দানে তওহীদের প্রকৃত রূপ প্রস্ফুটিত হয়। এ বাণীর অর্থ হল, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আল্লাহর রসূলের আনীত বিষয় ব্যতীত অন্য কিছু ইবাদত বা উপাসনা নয়। এই সেই বাণী ও সাক্ষ্য যার দ্বারা কাফের ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। যেহেতু এই কলেমাই হচ্ছে জান্নাতের কুঞ্চিকা। এই কলেমা তার পাঠকারীকে জান্নাতে প্রবেশ করায় যদি সে নিজ কর্ম দ্বারা তা পণ্ড করে তবে।

৫। কুরাইশের কাফের দল রসূল (সা.) এর নিকট তওহীদের দাওয়াত ও মুর্তির বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য ত্যাগ করার বিনিময়ে রাজ-সিংহাসন, অর্থ, বিবাহের জন্য সুন্দরীশ্রেষ্ঠা রমণী পেশ করেছিল। কিন্তু এতে তিনি সম্মত না হয়ে নিজ দাওয়াতে অটল ও নির্বিচল থাকলেন এবং নিজ সাহাবাবৃন্দ সহ নানা কেশ সহ্য করলেন। অতঃপর ১৩ বছর পরে তওহীদের দাওয়াত বিজয়ী। হল। এর পর মক্কা বিজয় হল এবং প্রতিমা ধ্বংস করা হল; যখন তিনি এই আয়াত পাঠ করেছিলেন,

جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا

অর্থাৎ, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয় মিথ্যা বিলীয়মান। (সূরা ইসরা’ ৮১ আয়াত)

৬। তওহীদ মুসলিমের জীবনে এক প্রধান কর্ম ও সাধনা। তাই তার জীবন শুরু করে তওহীদ দ্বারা আর তওহীদের মাধ্যমেই জীবনকে বিদায় করে। জীবনে তার ব্রত হল, তওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং তওহীদের প্রতি মানুষকে আহবান। যেহেতু তওহীদই মুমিন সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তওহীদী বাণীর পতাকাতলে মানুষকে সমবেত করে।।

আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন কলেমা তওহীদকে ইহলোক ত্যাগের সময় আমাদের শেষ বাক্য করেন। (আমীন)।

 তওহীদের কিছু মাহাত্ম্য

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলম দ্বারা কলুষিত করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন। এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হল, তখন মুসলিমদের নিকট বিষয়টি কঠিন মনে হল। বলল, ‘আমাদের মধ্যে কে আছে যে নিজের উপর যুলম (অন্যায়) করে না?” তা শুনে রসূল প্রিন্ট বললেন, তোমরা যে যুম মনে করছ) তা নয়। বরং তা (সবচেয়ে বড় যুগ্ম) কেবলমাত্র শির্ক। তোমরা কি পুত্রকে সম্বোধন করে লুকমানের উক্তি শ্রবণ করনি? (তিনি তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন),

يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, হে বৎস! আল্লাহর সহিত শির্ক করো না, নিশ্চয় শির্ক বড় যুলম। (বুখারী ও মুসলিম)

অত্র আয়াতটি সেই তওহীদবাদী মুসলিমদেরকে সুসংবাদ দেয়, যারা তাদের ঈমানকে শির্ক দ্বারা কলুষিত করেনি। সেই সুসংবাদ এই যে, তাদের জন্য রয়েছে পরকালে আল্লাহর শাস্তি হতে পূর্ণ নিরাপত্তা এবং তারাই ইহকালে সুপথ প্রাপ্ত।

২। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “ঈমান যাঠাধিক শাখাবিশিষ্ট। এর সর্বোত্তম শাখা লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত কেউ সত্য উপাস্য নেই) বলা এবং সর্বনিম্ন শাখা পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা।” (মুসলিম)।

৩। মহামান্য শায়খ আব্দুল্লাহ খাইয়াত্বের গ্রন্থ “দলীলুল মুসলিম ফিল ইতিক্বাদি অত্তাত্বহীর”-এ নিম্নরূপ বলা হয়েছেঃ

তওহীদ সুখের মূল কারণ এবং পাপ খালনকারী কোন ব্যক্তি যেহেতু সে মানুষ এবং নিষ্পাপ নয়- সেহেতু তার পদস্খলন ঘটতেই পারে ও আল্লাহর অবাধ্যাচরণে আপতিত হতেই পারে। পরন্তু সে যদি শির্কের কলুষমুক্ত বিশুদ্ধ তওহীদবাদী হয়, তাহলে তার আল্লাহর জন্য তাওহীদ এবং “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলায় তার ইখলাস (বিশুদ্ধ-চিত্ত) তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, পাপ মোচন এবং গোনাহর প্রায়শ্চিত্তের বৃহত্তম সহায়ক হবে। যেমন হাদীস শরীফে রসূল (সা.) এক্স বলেন, “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ (সত্য) উপাস্য নেই, তিনি একক, তার কোন অংশী নেই, মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও দুত (রসূল), ঈসাও আল্লাহর দাস, দুত এবং তার বাণী যা মারয়্যামের প্রতি প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং তাঁর তরফ হতে (বিশিষ্ট) রূহ, জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য - সে ব্যক্তি যে আমলই করে থাকুক, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

অর্থাৎ, এই সাক্ষ্যবাণীর সমষ্টি যা মুসলিম উক্ত মৌলিক বিষয়সমূহ উল্লেখ করে উচ্চারিত করে থাকে তা তার সুখদায়ক জান্নাত প্রবেশের কারণ অবশ্যই হবে- যদিও তার কিছু কর্ম ত্রুটি ও অবহেলাপূর্ণ হয়। যেমন হাদীসে কুদসীতে এর বর্ণনা এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি যদি প্রায় পৃথিবী-পুর্ণ পাপ নিয়ে আমার নিকট উপস্থিত হও আর আমার সহিত কোন কিছুকে শরীক না করে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর, তবে আমিও প্রায় পৃথিবীবরাবর ক্ষমা নিয়ে তোমার নিকট উপস্থিত হব।” (হাসান, তিরমিযী ও যিয়া)

অর্থাৎ, তুমি যদি প্রায় পৃথিবী-পুর্ণ পাপ ও অন্যায় করে থাক, কিন্তু তোমার মরণ তওহীদের উপর হলে আমি তোমার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেব।

অন্য এক হাদীসে এসেছে যে, “যে ব্যক্তি কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক না করে তার সহিত সাক্ষাৎ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যে ব্যক্তি কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক করে তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম)

উক্ত হাদীসসমূহের প্রত্যেকটি হতে তওহীদের মাহাত্ম ও গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় এবং এ কথা স্পষ্ট হয় যে, তওহীদ বান্দার চিরসুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের বৃহত্তম সহায়ক এবং পাপক্ষালনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।

 তওহীদের কতিপয় উপকারিতা

ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে বিশুদ্ধ তওহীদ বাস্তবায়িত হলে তাতে উৎকৃষ্টতম ফল লাভ হয়। এর কিছু ফল নিম্নরূপ :

১। আল্লাহ ছাড়া বিভিন্ন বস্তু, ব্যক্তি বা সৃষ্টির পদানতি ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তি'; যে সৃষ্টি কোন কিছু সৃজন করতে পারে না বরং তারা নিজেই সৃষ্ট; যারা নিজেদের মঙ্গলামঙ্গলের মালিক নয় এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরেও কোন ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং তওহীদ সুঠাম আকৃতিতে সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালক ছাড়া অন্য সকল কিছুর দাসত্ব হতে মানুষকে স্বাধীনতা দান করে। বাতিল চিন্ত-ধারা ও কুসংস্কার হতে মস্তিষ্ক মুক্ত করে। পদানতি, হীনতা ও পরবশ্যতা হতে হৃদয়-মনকে অব্যাহতি দেয় এবং সর্বপ্রকার ফেরাউন, বাতিল প্রভু, গণকদল ও আল্লাহর বান্দাদের উপর খোদায়ী দাবীদারদের আধিপত্য। হতে মানব জীবনকে নিস্কৃতি দেয়। তাই তো মুশরিক (অংশীবাদী)দের দলপতিরা এবং জাহেলিয়াতের দুর্দম স্বেচ্ছাচারীরা সাধারণভাবে সকল আম্বিয়ার ও বিশেষভাবে শেষ রসূল (সা.) এর দাওয়াতের ঘোর বিরোধিতা করেছে এবং তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। যেহেতু তারা জানত যে, ‘লা ইলাহার অর্থই হচ্ছে মানুষের মুক্তি, মিথ্যা সিংহাসন হতে পরাক্রমশালীদেরকে বিচ্যুতকরণ এবং মুমিনদের সেই ললাটসমুহ সুউন্নতকরণের এক সাধারণ ঘোষণা, যে ললাটসমূহ একমাত্র বিশ্বজাহানের মহান প্রতিপালক ছাড়া অন্য কিছুর নিকট অবনত হয় না।

২। ভারসাম্যপূর্ণ সুসমঞ্জস ব্যক্তিত্ব গঠন। তওহীদ সুসমঞ্জস ব্যক্তিত্ব-গঠনে। সহায়তা করে; যে ব্যক্তিত্বের গতিমুখ ও লক্ষ্য জীবনে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং যার উদ্দেশ্য ও গন্তব্যস্থলও একটাই। তাই তার একক উপাস্য ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। নির্জনে ও প্রকাশ্যে সে যার অভিমুখী এবং সুখে ও দুখে যাকে সে আহবান করে থাকে। পক্ষান্তরে মুশরিক, যার অন্তরকে অসংখ্য উপাস্য ও মাবুদ বিভক্ত করে নিয়েছে। ফলে কখনো সে জীবিতের মুখাপেক্ষী হয় আবার কখনো মৃতের। এরই দিকে লক্ষ্য করে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন,

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ

অর্থাৎ, হে কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন একাধিক প্রতিপালক শ্রেয়, নাকি এক পরাক্রমশালী আল্লাহ? (সূরা ইউসুফ ৩৯ আয়াত)

সুতরাং মুমিন একই উপাস্যের উপাসনা করে। সে জানে যে, কি তাকে সন্তুষ্ট করে এবং কি অসন্তুষ্ট করে। তাই সে ঐ কর্মই করে, যাতে তিনি সন্তুষ্ট এবং এতে তার হৃদয় প্রশান্ত থাকে। আর মুশরিক বহু সংখ্যক মাবুদের ইবাদত করে; একজন তাকে ডানে নিয়ে যেতে চায় এবং অপরজন বামে। ফলে সে সবার মাঝে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ও অস্বচ্ছন্দ হয়ে পড়ে, যার কোন স্থিরতা থাকে না।

৩। তওহীদ নিরাপত্তার উৎস। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীর হৃদয়কে নিরাপত্তা ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দেয়। তাই সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। রুজী-রুটি, নিজের আত্মা ও আত্মীয়-পরিজনের উপর ভয়ের সমস্ত ছিদ্রপথ সে বন্ধ করে থাকে। মানুষ, জিন, মৃত্যু ইত্যাদি হতে ভয় এবং আরো অন্যান্য সকল ভয় হতে সে নির্ভয় থাকে। কারণ তওহীদবাদী মুমিন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। তাই আপনি তাকে দেখবেন যে, মানুষ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত তখন সে অকুতোভয় এবং সকলে যখন উদ্বিগ্ন ও অস্থির তখন সে প্রশান্ত ও স্থিরচিত্ত।

এই অর্থের প্রতিই কুরআন করীমে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে অন্যায় (শিক) দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্যই তো রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)

অবশ্য এই নির্বিঘ্নতা চিত্তের অভ্যন্তর হতে নিঃসৃত ও অনুভূত হয়, প্রহরীর প্রহরা হতে নয়। আর এটা হল ইহলৌকিক নিরাপত্তা। পরন্তু পারলৌকিক নিরাপত্তা তো সর্ববৃহৎ ও চিরস্থায়ী। কারণ তারা কেবল আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ-চিত্ত এবং তারা তাদের তওহীদকে শির্কের কলুষ দ্বারা সংমিশ্রিত করেনি। যেহেতু শির্ক করা বড় যুম্ন।

৪। তওহীদ আত্মিক শক্তির উৎপত্তিস্থল। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীকে দুর্দান্ত আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বল দান করে। কারণ তার আত্মা-মন আল্লাহর সকাশে আশা, আস্থা, ভরসা, তার লিখিত ভাগ্যের উপর সন্তুষ্টি, তাঁর তরফ হতে আগত বিপদের উপর ধৈর্য, তার সৃষ্টি হতে অমুখাপেক্ষিতা দ্বারা পরিব্যাপ্ত। তাই সে পর্বতের ন্যায় সুদৃঢ় অটল। পরন্তু যখন তার উপর কোন বিপদ আসে তখন সে স্বীয় প্রভুর নিকট তা হতে উদ্ধার চায়। আর কোন মৃতের নিকট বিপদ মুক্তি চায় না। যেহেতু তার আদর্শ বচন হল, নবী (সা.) ঐক-এর এই বাণী “যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং সাহায্য। প্রার্থনা করলে আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, তিনি বলেন, হাসান সহীহ) এবং আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ, আর আল্লাহ যদি তোমাকে বিপদে ফেলেন তাহলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। (সূরা আনআম ১৭ আয়াত)

৫। তওহীদ ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের মূল ভিত্তি। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীদেরকে একথার অনুমতি দেয় না যে, তারা আল্লাহকে ছেড়ে একে অপরকে নিজেরদের প্রভু বানিয়ে নিক। কারণ উপাস্যত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ এবং সমগ্রমানবকুল ও তার শীর্ষস্থানে মুহাম্মদ ও তাঁর রসূল (সা.) এবং নির্বাচিত ও মনোনীত নবী (সা.) ও তাঁর দাস। (ডক্টর ইউসূফ আল-কারযাবীর গ্রন্থ ‘হাকীকাতুত তাওহীদ’ হতে কিছু রদবদলের সহিত সংগৃহীত)

 তওহীদের দুশমন

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا

অর্থাৎ, এরূপে শয়তান মানুষ ও জিনদেরকে আমি প্রত্যেক নবী (সা.)র শত্রু করেছি, যারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে। (সূরা আনআম ১১২ আয়াত)।

আল্লাহর হিকমত চেয়েছে যে, তিনি আম্বিয়া ও তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের বিরুদ্ধে কিছু শয়তান জিনকে শত্রু নির্ধারণ করেছেন যারা ভ্রষ্টতা, অমঙ্গল ও বাতিল কথা দ্বারা শয়তান মানুষদেরকে প্ররোচিত করে থাকে। যাতে তারা মানুষকে ভ্রষ্ট করে দেয় এবং তাদেরকে সেই তওহীদ হতে ব্যাহত করে; যার প্রতি আম্বিয়াগণ স্ব-স্ব সম্প্রদায়কে সর্বপ্রথম আহবান করেছেন। কারণ এই তওহীদ হল সেই আসল বুনিয়াদ, যার উপর ইসলামী দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু আশ্চর্যের কথা যে, কিছু লোক তওহীদের দাওয়াতকে উম্মাহর মাঝে বিছিন্নতা সৃষ্টির কারণ বলে গণ্য করে। অথচ তওহীদই উম্মাহর মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির কারণ। তওহীদ (একত্ববাদ)এর নামই সেই কথার নির্দেশ করে।

পক্ষান্তরে মুশরিকদল যারা তাওহীদূর রবুবিয়্যাহ’ (প্রতিপালকের একত্ববাদ)কে স্বীকার করেছিল এবং মেনে নিয়েছিল যে, আল্লাহই তাদের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ’ (উপাস্যত্বের একত্ববাদ)কে অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাকেই ডাকতে অস্বীকার করেছিল এবং তারা তাদের আওলিয়াকে ডাকা ও তাদের নিকট প্রার্থনা করা বর্জন করেনি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদেরকে দুআ ও ইবাদতে আল্লাহর তওহীদ (একত্ববাদ)কে স্বীকার করতে ও মেনে নিতে আহবান করলে তারা তার সম্পর্কে বলেছিল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, সে কি সমস্ত উপাস্যকে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে ? এতো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! (সূরা স্বা-দ ৫ আয়াত)

পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

كَذَٰلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ * أَتَوَاصَوْا بِهِ ۚ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ

অর্থাৎ, এরূপে এদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রসূল এসেছে ওরা তাকে বলেছে, (তুমি তো) এক যাদুকর অথবা পাগল! ওরা কি একে অপরকে এই মন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে? বরং ওরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। (সূরা যারিয়াত ৫২ আয়াত)

মুশরিকদের চরিত্র এই যে, তারা যখন এক আল্লাহকেই ডাকার কথা শোনে, তখন তাদের হৃদয় সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং অনীহ ও চকিত হয়ে উঠে। ফলে (তওহীদবাদীদেরকেই) কাফের বলে অভিহিত করে এবং তাদেরকে বাধা দিতে প্রয়াস পায়। পক্ষান্তরে যখন তারা শির্ক এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে ডাকার কথা শোনে, তখন তারা উৎফুল্ল ও আনন্দিত হয়। আল্লাহ তাআলা ঐ মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন,

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ ۖ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

অর্থাৎ, যখন আল্লাহ এক’ এ কথার উল্লেখ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাসী নয় তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে অন্যান্য বাতিল উপাস্যদের উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়। (সূরা যুমার ৪৫ আয়াত)

তওহীদ অস্বীকারকারী মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন,

ذَٰلِكُم بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ ۖ وَإِن يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا ۚ فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ

অর্থাৎ, তোমাদের এ শাস্তি তো এজন্য যে, যখন আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই’ বলা হয়েছে তখন তোমরা অবিশ্বাস করেছ এবং তার সহিত শরীক করা হলে তা বিশ্বাস করেছ, সুতরাং সুউচ্চ, সুমহান আল্লাহরই সমস্ত কর্তৃত্ব। (সূরা মু’মিনঃ ১২ আয়াত)

অত্র আয়াতগুলি কাফেরদের প্রসঙ্গে হলেও তা সেই ইসলামের দাবীদারদের উপরেও প্রযোজ্য যারা ওদের গুণে গুণান্বিত। যারা তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাদের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং ঘৃণ্য খেতাবে তাঁদেরকে অভিহিত করে; যাতে তাদের নিকট হতে মানুষকে দুরে রাখতে সক্ষম হয় এবং সেই তওহীদ হতে মানুষকে সাবধান করে ও দুরে রাখে, যে তওহীদের কারণেই আল্লাহ তার সমস্ত রসূল প্রেরণ করেছেন। ওদের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছে যারা আল্লাহর নিকট দুআ ও প্রার্থনা করতে শুনলে বিনত হয় না অথচ তিনি ছাড়া অন্য কারো নিকট দুআ ও প্রার্থনা করতে শুনলে; যেমন রসূল বা আওলিয়াদের নিকট মদদ চাইতে শুনলে বিনয়াবনত ও উল্লসিত হয়। সুতরাং তারা যা করে তা কত নিকৃষ্ট!

 তওহীদ প্রসঙ্গে উলামার ভুমিকা

উলামা আম্বিয়ার উত্তরাধিকারী। সকল নবী (সা.) প্রথম যে কথার প্রতি আহবান করেন তা হল তওহীদ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

অর্থাৎ, অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রসূল প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাগুত বর্জন কর। (সূরা নাহল ৩৬ আয়াত)

(তাগুত বলা হয় প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকে, যাকে আল্লাহর পরিবর্তে পূজা ও মান্য করা হয় এবং সে উক্ত পূজায় সম্মত ও সন্তুষ্ট থাকে।)

এই জন্যই আলেম সমাজের উচিত তাই দিয়ে দাওয়াত শুরু করা; যা দিয়ে রসূলগণ করেছিলেন। অতএব দাওয়াতের প্রারম্ভে মানুষকে সকল প্রকার ইবাদতে বিশেষ করে দুআ ও প্রার্থনা করাতে আল্লাহর তওহীদের (আল্লাহকে একক উপাস্য মানার) প্রতি আহবান করা কর্তব্য। যেহেতু দুআ সম্পর্কে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন, “দুআই তো ইবাদত।” (তিরিমযী এবং তিনি এটিকে হাসান বলছেন)।

বর্তমানযুগে অধিকাংশ মুসলমান শির্ক এবং গায়রুল্লাহকে ডাকাতে এবং তাদের নিকট প্রার্থনা ও আবেদন করাতে অভ্যাসী হয়ে পড়েছে। যা তাদের এবং পূর্ববর্তী জাতির দুর্দশার মূল কারণ। যে সব জাতি সমূহকে আল্লাহর পরিবর্তে আওলিয়াগণকে ডাকার কারণে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন।

তওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং শির্ক উচ্ছেদকরণের প্রতি উলামাগণের বিভিন্ন প্রকার ভূমিকা পরিদৃষ্ট হয়ঃ

১। প্রথম প্রকার উলামা যারা তওহীদ, তার গুরুত্ব ও প্রকারভেদ উপলদ্ধি করেছেন, শির্ক ও তার প্রকারভেদ জেনেছেন। অতঃপর তারা তাদের কর্তব্য পালনে সক্রিয় হয়েছেন। তওহীদ ও শির্ক মানুষের নিকট খোলাখুলি ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যাদের দলীল কুরআন কারীম এবং সহীহ সুন্নাহ (হাদীস)। এই শ্রেণীর উলামাগণ মিথ্যা অপবাদের সম্মুখীন হয়েছেন যেমন আম্বিয়াগণ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা পশ্চাৎপদ না হয়ে ধৈর্যের সাথে স্বকর্তব্য পালন করেছেন। তাঁদের আদর্শ নীতিবাক্য হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার বাণী,

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

অর্থাৎ, লোকে যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে ওদেরকে উপেক্ষা করে চল। (সূরা মুযযাম্মিল ১০ আয়াত)

প্রাচীনকালে লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে অসিয়ত করে বলেছিলেন,

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

অর্থাৎ, হে বৎস! যথাযথভাবে নামায পড়বে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে, অসৎকাজে বাধা দান করবে এবং বিপদে ও কষ্টে ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয় এসব দৃঢ় সংকল্পের কাজ। (সূরা লুকমানঃ ১৭ আয়াত)

২। দ্বিতীয় প্রকার উলামা যারা তওহীদের প্রতি দাওয়াতকে উপেক্ষা ও অবহেলা করেছেন, যে তওহীদ হল ইসলামের মূল বুনিয়াদ। ফলে তারা মুসলিমদের আকীদাহ ও বিশ্বাস সংশোধন না করে তাদেরকে নামাযে যত্নবান হতে, আল্লাহর বিধান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা (কল্পে সংগঠন) করতে এবং তাঁর পথে জিহাদ করতে আহ্বান করেছেন। (অর্থাৎ বিনা ভিত্তিতে ইমারত গড়ার প্রচেষ্টা করেছেন। যেন তাঁরা আল্লাহ তাআলার এই বাণী শ্রবণ করেননি,

وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, ওরা যদি শির্ক করত, তবে ওদের সকল কৃতকর্ম পন্ড হয়ে যেত। (সূরা আনআম ৮৮ আয়াত)

অথচ তারা যদি রসূলগণের মত অন্যান্য আমলের পুর্বে তওহীদকে অগ্রণী করতেন তাহলে তাদের দাওয়াত সাফল্যমন্ডিত হত এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতেন যেমন নবী ও রসূলগণকে তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন,

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে তাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন। তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে -যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন সুদৃঢ় করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার উপাসনা করবে, আর আমার সহিত কিছুকে অংশী স্থাপন করবে না। অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাই সত্যত্যাগী (ফাসেক)। (সূরা নূর ৫৫ আয়াত)

সুতরাং বিজয়ের বুনিয়াদী শর্ত হল তওহীদ প্রতিষ্ঠাকরণ।

৩। তৃতীয় প্রকার উলামা ও দাওয়াত পেশকারী, যারা লোকেদের আক্রমণের ভয়ে অথবা নিজ চাকুরী, পদ বা গদি যাবার ভয়ে তওহীদের প্রতিষ্ঠা ও শির্ক উমুলনকল্পে দাওয়াত ত্যাগ করে বসেছেন। আর এতে তারা সেই ইলম (জ্ঞান) গুপ্ত করেছেন যা মানুষের মাঝে প্রচার করতে আদিষ্ট ছিলেন। ফলে আল্লাহর এই বাণী তাদের জন্য নিরূপিত হয়েছে,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে কিতাবে আমার ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং অভিশাপদাতারাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৯ আয়াত)

যারা দ্বীনের দাওয়াত দেন তাদের বাঞ্ছনীয় গুণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ

অর্থাৎ, যারা আল্লাহর বাণী প্রচার করে, তাকে ভয় করে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ও ভয় করে না। (সূরা আহযাব ৩৯ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন ইলম (জ্ঞান) গোপন করে আল্লাহ তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

৪। চতুর্থ প্রকার উলামা ও পীরের দল; যারা তওহীদের প্রতি দাওয়াত, একমাত্র আল্লাকেই ডাকা এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন নবী (সা.), ওলী বা মৃতকে না ডাকার নীতির বিরোধিতা করেন। কারণ এঁদের নিকট নবী (সা.)-ওলীকে ডাকা (অসীলা করা) বৈধ তাই। যে আয়াতে গায়রুল্লাহকে ডাকতে নিষিদ্ধ ও সাবধান করা হয়েছে সেই আয়াতকে এঁরা কেবল (অমুলিম) মুশরিকদের জন্য নিরূপিত করেন এবং মনে করেন যে, মুসলমানদের মধ্যে মুশরিকদের পর্যায়ভুক্ত কেউ নেই! যেন তাঁরা আল্লাহ তাআলার এই বাণী শ্রবণ করেননি,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে কোন যুম দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)

উক্ত আয়াতে যুলমের অর্থ হল শির্ক। এর দলীল আল্লাহর এই বাণী,

إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, অবশ্যই শির্ক মহা যুলম। (সূরা লুকমান ১৩ আয়াত)

সুতরাং উল্লেখিত আয়াতে একথাই সুস্পষ্ট হয় যে, মুসলিম এবং মু'মিনও শির্কে আপতিত হয়; যেমন বহু মুসলিম বিশ্বের মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি। পক্ষান্তরে ওঁরা, যারা নবী (সা.)-ওলীকে বিপদে ডাকা বা অসীলা মানা বৈধ বলে মানুষকে ফতোয়া দেন, মসজিদের ভিতর মৃত সমাধিস্ত করা, কোন ওলীর কবরের তওয়াফ করা, আওলিয়াদের নামে নর-নিয়ায পেশ করা প্রভৃতি বিদআত ও শরীয়ত-বিরোধী আচরণকে বৈধ ও সমীচীন বলে ঘোষণা করেন - তাদের ব্যাপারে রসূল ধ্রুকু মুসলিমকে সাবধান ও সতর্ক করেছেন; তিনি বলেন, “আমি আমার উম্মতের উপর ভ্ৰষ্টকারী ইমাম (আলেম ও নেতা প্রভৃতি)র দলকেই ভয় করি।” (সহীহ তিরমিযী) আযহারের এক প্রয়াত ওস্তাদকে কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায বৈধতার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায বৈধ হবে না কেন? এই দ্যাখেন না, রসুলুল্লাহর কবর মসজিদের ভিতরেই এবং লোকেরা তাঁর কবরের প্রতি মুখ করে নামায পড়ে থাকে?

অথচ রসূল (সা.) এর দাফন মসজিদের ভিতর হয়নি বরং আয়েশা (রাঃ) এর। হুজরায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। পরন্তু তিনি কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায পড়তে নিষেধ করে গেছেন। রসূল (সা.) দুআ করতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি সেই ইম হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা কোন লাভ দেয় না। (মুসলিম) (অর্থাৎ এমন ইলম হতে পানাহ চাচ্ছি যা আমি অপরকে শিখাই না, যার উপর আমল করি না এবং যার দ্বারা আমার চরিত্রও পরিবর্তিত হয় না।)

৫। যারা আপন মুরশিদ ও হুজুরদের কথাই অন্ধভাবে মান্য করে থাকে এবং আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করে তাদের আনুগত্য ও অনুকরণ করে বস্তুতঃ তারা। রসূল (সা.) এর এই বাণীর বিরুদ্ধাচরণ করে। তিনি বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।” (সহীহ, মুসনাদে আহমদ)

অবশ্যই এই আনুগত্যের দরুন তারা কিয়ামতে লাঞ্ছিত হবে। আর তখন লাঞ্ছনা কোন উপকার দেবে না। কাফেরদল ও তাদের পথ অনুসরণকারীদের শাস্তি বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا * وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا * رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

অর্থাৎ, যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমন্ডল উল্টে-পাল্টে দগ্ধ করা হবে সেদিন ওরা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করতাম।” তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতা ও বুযুর্গদের আনুগত্য করেছিলাম এবং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল ; হে আমাদের। প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা-অভিসম্পাত করুন। (সূরা আহযাব ৬৬-৬৮ আয়াত)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর বলেন, “অর্থাৎ, আমরা আমাদের আমীর (নেতা) এবং উলামা ও পীর-বুযুর্গদের অনুকরণ, আর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাম। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, ওদের নিকট কিছু আছে এবং ওরা কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত আছে। (অর্থাৎ প্রকৃত সত্য ওদের নিকটেই আছে এবং ওব্রা প্রকৃত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ দেখছি,) ওরা কিছুরই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।”

 ওয়াহাবীর অর্থ কি?

লোকেরা প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকেই ওয়াহাবী’ বলে অভিহিত করে থাকে, যে ব্যক্তি তাদের প্রথা ও অভ্যাস, বিশ্বাস ও বিদআতের বিরোধিতা করে যদিও তাদের ঐ সকল বিশ্বাস অমূলক ও ভ্রষ্ট; যা কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস সমুহের পরিপন্থী। বিশেষ করে তওহীদের কথা বললে এবং অন্যান্যকে ছেড়ে কেবল একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে নির্দেশ দিলে তারা ঐ খেতাব দিয়ে থাকে।

একদা এক আলেমের নিকট ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’ গ্রন্থ হতে ইবনে আব্বাসের এই হাদীস পড়েছিলাম; নবী (সা.) বলেন, “যখন চাইবে, তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, এবং তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।) নবীর ব্যাখ্যা আমার বড় পছন্দ হল; তিনি বলেন, '--- অতঃপর যে প্রয়োজন মানুষ ভিক্ষা করে তা পূরণ করার ক্ষমতা যদি সৃষ্টির হাতে না থাকে, যেমন সুপথ (হেদায়াত) ও ইলম (জ্ঞান) প্রার্থনা, আরোগ্য ও নিরাপত্তা ভিক্ষা ইত্যাদি, তাহলে তা প্রতিপালকের নিকটই চাইবে। পক্ষান্তরে সৃষ্টির নিকট চাওয়া এবং তাদের উপর ভরসা করা নিন্দনীয়।

অতঃপর আমি ঐ মওলানাকে বললাম, 'এই হাদীস এবং এর ব্যাখ্যা গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা অবৈধ হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। তিনি আমাকে বললেন, 'বরং (গায়রুল্লাহর নিকটেও সাহায্য ভিক্ষা করা) বৈধ। আমি বললাম, আপনার দলীল কি? এতে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে উচ্চ কণ্ঠে। বললেন, 'আমার ফুফু বলেন, “হে (বাবা) শায়খ সা’দ সাহেব!’ (অথচ তিনি তার মসজিদে সমাধিস্ত, ফুফু তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।) আমি তাকে বলি, ফুফুজান! (বাবা) শায়খ সা’দ সাহেব কি আপনার উপকার করতে পারবেন? ফুফু বলেন, 'আমি উনার নিকট প্রার্থনা করি। উনি এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি মধ্যস্থতা করেন, যাতে তিনি আমাকে রোগমুক্ত করে দেন!! আমি শায়েখকে বললাম, আপনি একজন আলেম মানুষ! বই পঠন-পাঠনে বয়স অতিবাহিত করে ফেলেছেন, তা সত্ত্বেও এসব কিছুর পরে আপনি আপনার অজ্ঞ ফুফুর নিকট আকীদাহ গ্রহণ করেছেন?!’ তখন তিনি আমাকে বললেন, 'তোমার নিকট ওয়াহাবী চিন্তাধারা আছে। তুমি ওমরা করতে যাও, আর ওয়াহাবী বই পুস্তক বয়ে নিয়ে আস!

আমি অবশ্য ওয়াহাবী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে হুজুরদের মুখে বহুবার বলতে শুনেছি। হুজুররা তাদের সম্পর্কে বলেন, ওয়াহাবীরা সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে, ওরা আওলিয়া এবং তাদের কারামতকে বিশ্বাস করে না,

রসূলের প্রতি ওদের মহব্বত নেই’ ইত্যাদি মিথ্যা অপবাদ! তখন আমি মনে মনে বলতাম, ওয়াহাবীরা যদি একমাত্র আল্লাহর নিকটেই সাহায্য ভিক্ষা করাতে এবং আরোগ্যদাতা একমাত্র আল্লাহ -এই কথাতে বিশ্বাসী হন, তাহলে তাঁদের সম্পর্কে পরিচয় লাভ করা আমার একান্ত জরুরী। সে জামাআত কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সকলে বলল, ওদের এক নির্দিষ্ট স্থান আছে, যেখানে ওরা প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জমায়েত হয়ে তফসীর, হাদীস ও ফিকহ অধ্যয়ন করে।

আমি আমার ছেলেদেরকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি শিক্ষিত যুবককে সাথে করে তাদের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। এক বৃহৎ কক্ষে প্রবেশ করে দর্সের অপেক্ষায় বসলাম। ক্ষণেক পরেই এক বয়স্ক শায়খ কক্ষে প্রবেশ করতেই আমাদেরকে সালাম দিলেন এবং তার ডান দিকে হতে শুরু করে সকলের সাথে মুসাফাহা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁর বসার স্থানে বসলেন। তার জন্য কেউই উঠে দণ্ডায়মান হয়নি। আমি মনে মনে বললাম, “ইনি তো বড় বিনয়ী শায়খ, দন্ডায়মান হওয়া (কিয়াম) পছন্দ করেন না বুঝি।” অতঃপরঃ

إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفر

বলে তিনি তার দর্স শুরু করলেন। খুতবাটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন, যে খুতবা রসূল ধ্র পাঠ করে তাঁর ভাষণ ও দর্স আরম্ভ করতেন। অতঃপর আরবী ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। হাদীস উল্লেখ করলে তার শুদ্ধঅশুদ্ধতা এবং বর্ণনাকারীর অবস্থা বর্ণনা করেন। নবী (সা.) এর নাম এলেই তাঁর উপর দরূদ পাঠ করেন। পরিশেষে কাগজে লিখিত কতকগুলি প্রশ্ন তাকে করা হল। তিনি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উদ্ধৃত দলীল সহ উত্তর দিলেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ তার সহিত বাদানুবাদও করলেন। কোন প্রশ্নকারীকে উত্তর না দিয়ে তিনি ফিরিয়ে দিলেন না। অতঃপর দর্সের শেষে বললেন, ‘আল্লাহর শত প্রশংসা যে, আমরা মুসলিম ও সালাফী।* কিছু লোক বলে থাকে আমরা ওয়াহাবী। অথচ এটা হল নামের খেতাব বের করা যা থেকে আল্লাহ আমাদেরকে নিষেধ করেছেন; তিনি বলেন,

(وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ) অর্থাৎ, আর তোমরা এক অপরের মন্দ খেতাব বের করো না। (সূরা হুজুরাত ১১ আয়াত)

পূর্ব যুগে লোকেরা ইমাম শাফেয়ীকে রাফেযী* বলে অপবাদ দিলে তিনি তাদের প্রতিবাদে বলেছিলেন,

‘মুহাম্মদের বংশধরের প্রতি ভালবাসা রাখা

যদি ‘রফয’ (রাফেযী হওয়া) হয়।

তাহলে মানব-দানব সাক্ষী থাকুক যে, আমি রাফেযী।” তদনুরূপ আমাদেরকে যারা ওয়াহাবী বলে অপবাদ দেয় তাদের প্রতিবাদে এক কবির মত বলি যে,

‘আহমদের (সা.) অনুসারী যদি ওয়াহাবী হয়,

তাহলে আমি স্বীকার করছি যে, আমি একজন ওয়াহাবী।” অতঃপর দর্স শেষ হলে কিছু যুবকের সহিত আমরা বের হয়ে এলাম। তার ইলম ও বিনয় দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। এক যুবককে বলতে শুনলাম, ‘উনিই হচ্ছেন প্রকৃত শায়খ!”

তওহীদের দুশমনরা তওহীদবাদীকে ‘ওয়াহাবী’ বলে অভিহিত করে। এতে তারা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এর প্রতি সম্বন্ধ করে। অথচ সত্য ও সঠিক বললে তাঁর নাম মুহাম্মাদ এর প্রতি সম্বন্ধ জুড়ে ‘মুহাম্মদী’ বলত। আল্লাহর ইচ্ছা তাই ওয়াহহাবী” ওয়াহহাব’ এর প্রতি সম্বদ্ধ হয়েছে; যা। আল্লাহর সন্দরতম নামাবলীর অন্যতম নাম।

একজন সূফী যদি এমন এক জামাআতের সহিত সম্বন্ধ রাখে যারা সূফ’ (পশমবস্ত্র) পরিধান করে (ফলে তাকে সুফী বলা হয়, তাহলে একজন ওয়াহহাবী’ ও ‘আল-ওয়াহাহহাব’-এর প্রতি সম্বন্ধ রেখে (গর্ব অনুভব করতে পারে)। যেহেতু আল-ওয়াহাহহাব’ (মহাদাতা) হলেন আল্লাহ। যিনি তাকে তওহীদ দান করেছেন এবং তওহীদের দাওয়াত পেশ করতে তাকে সক্ষম ও সুদৃঢ় করেছেন।

* সালাফীঃ যারা সলফে সালেহ(রসূল ও সাহাবা)র পথ অনুসরণ করেন।

** রাফেযাহঃ শিয়াহ সম্প্রদায়ের একটি ফিরকার নাম। (অনুবাদক)

 মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্‌হাব

শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদের (সউদী আরবের রাজধানী রিয়া থেকে প্রায় ৫০ কিমি পশ্চিমে) উয়াইনাহ শহরে ১১১৫ হিজরী সনে। জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স দশ বছর হওয়ার পূর্বেই কুরআন হিফয করেন। আপন পিতার নিকট হাম্বলী ফিকহ অধ্যয়ন করেন এবং দেশের বিভিন্ন শায়খদের নিকট হাদীস ও তফসীর পাঠ করেন। বিশেষ করে মদীনা নববিয়্যার উলামাদের নিকট (শরীয়তের জ্ঞান লাভ করেন)। কিতাব ও সুন্নাহ হতে তওহীদকে বুঝেন। অতঃপর তিনি নিজ দেশ নাজদে এবং যে সব দেশ তিনি ভ্রমণ করেন সেখানে শির্ক, কুসংস্কার, বিদআত এবং সঠিক ইসলামের পরিপন্থী কবরপূজা দেখে শঙ্কিত হলেন।

নিজ দেশের অনুঢ়া যুবতীদের। দেখলেন, তারা ষাড়া খজুর বৃক্ষের অসীলায় প্রার্থনা করছে, বলছে, 'ওহে যাড়া বনস্পতি! বছর না ঘুরতেই চাই আমি পতি!’ হিজাযে দেখলেন, সাহাবাব, আহলে বায়ত এবং রসূলের কবরসমূহ ভক্তির আতিশয্যে পবিত্ররূপে পুজিত হচ্ছে -যে ভক্তি ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। মদীনায় তিনি শুনলেন, আল্লাহর পরিবর্তে রসূল (সা.) প্লঃ-এর নিকট লোকে সাহায্য প্রার্থনা করছে; যা কুরআন ও রসূলের বাণীর পরিপন্থী। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডেকো না; যা তোমার উপকারও। করে না এবং অপকারও করে না, কারণ এ করলে তুমি যালেম (মুশরিক)-দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা ইউনুস ১০৬ আয়াত)

রসূল (সা.) স্বীয় পিতৃব্য-পুত্রকে সম্বোধন করে বলেন, 'যখন কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী এবং তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।) শায়খ একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে এবং তওহীদ বরণ করে নিতে মানুষকে আহ্বান করতে আরম্ভ করলেন। যেহেতু আল্লাহই সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আর বাকী সকল সৃষ্টি নিজের ও অপরের অমঙ্গল দূরীকরণে অক্ষম। আর যেহেতু সালেহীন (আওলিয়া)র মহব্বত তাঁদের অনুসরণ করে প্রকাশ হয়, আল্লাহ ও নিজেদের মাঝে তাদেরকে অসীলা বা মাধ্যম মেনে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদেরকে আহবান করে নয়।

১. বাতিলপন্থীদের বিরোধিতাঃ যে তওহীদী দাওয়াতের গুরুভার শায়খ গ্রহণ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে বিদআতীরা প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াল। অবশ্য এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, যেহেতু তওহীদের দুশমনরা রসূল প্ল-এর যুগেও ঐ দাওয়াতের বিরোধিতা করেছিল। তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, ওকি সকল মাবুদকে একই মা'বুদ বানিয়ে নিয়েছে? এতো আশ্চর্যের ব্যাপার! (সূরা সাদ ৫ আয়াত)

শায়খের শত্রুরা তার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ শুরু করে দিল। তার প্রসঙ্গে মিথ্যা অপবাদ প্রচার করতে লাগল। তাকে হত্যা করে তার ঐ দাওয়াত হতে নিস্কৃতিলাভের জন্য ষড়যন্ত্র করল। কিন্তু আল্লাহ তার হিফাযত করলেন এবং তার জন্য এক সহায়ক নিযুক্ত করে দিলেন। যার ফলে হিজায ও অন্যান্য মুসলিম দেশে তওহীদী দাওয়াত প্রচার ও প্রসার লাভ করল। কিন্তু অদ্যাবধি কিছু লোক সেই মিথ্যা অপবাদ প্রচারে ব্যস্ত। ওরা বলে, তিনি পঞ্চম আরো এক নতুন মহাব প্রবর্তন করেছেন, অথচ তার মযহাব হল। হাম্বলী। ওরা আরো বলে, ওয়াহাবীরা রসূলকে ভক্তি করে না বা ভালোবাসে না ও তার উপর দরূদ পড়ে না। অথচ শায়খ রাহেমাহুল্লাহ মুখতাসারু সীরাতির রসূল (সাঃ)” নামে এক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। যা এ কথারই দলীল যে, তিনি রসূল (সাঃ)-কে ভালোবাসেন। ওা তার নামে আরো বিভিন্ন অপবাদ ও কুৎসা রটিয়ে থাকে, যে সম্পর্কে কাল কিয়ামতে ওদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি ওরা ইনসাফের সাথে উদার মনে তাঁর কিতাবসমূহ অধ্যয়ন। করত, তবে নিশ্চয় তাতে কেবল কুরআন, হাদীস ও সাহাবাবর্গের উক্তিই দেখতে পেত।

এক সত্যবাদী ব্যক্তি আমাকে জানান যে, এক আলেম তার দর্সে লোকদেরকে ওয়াহাবী থেকে সাবধান করতেন। উপস্থিতগণের মধ্য হতে এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের লিখা একটি পুস্তক লেখকের নাম সহ প্রথম পৃষ্ঠা ছিড়ে তাকে পড়তে দিলেন। তিনি তা পড়ে পছন্দ করলেন। অতঃপর যখন লেখক সম্পর্কে জানলেন তখন তিনি তার প্রশংসা করতে লাগলেন।

২। হাদীসে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম ও ইয়ামানে বৰ্কত (প্রাচুর্য) দান কর।” সকলে বলল, আর আমাদের নজদে?” তিনি বললেন, “ওখান হতে শয়তানের শৃঙ্গ উদিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম)

ইবনে হাজার আস্‌কালানী প্রভূতি ওলামাগণ উল্লেখ করেন যে, হাদীসে উল্লেখিত ঐ নজদ হল ইরাকের নজদ। সুতরাং ইরাকেই যত বড় বড় ফিতনা ফাসাদের প্রাদুর্ভাব ঘটে। হুসাইন বিন আলী , ওখানেই শহীদ হন। কিন্তু এর বিপরীত, কিছু লোক মনে করে উক্ত নজদ’ বলতে হিজাযের নজদ’কে বুঝানো হয়েছে। অথচ সেখানে কোন ফিতনাহ দেখা দেয়নি যেমন ইরাকে বহু ফিতনা দেখা দিয়েছে। বরং হিজাযের নজদ থেকে তো সেই তওহীদের সংস্কার সাধন হয়েছে যার কারণে বিশ্বজগৎ রচিত এবং যার কারণে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন।[১]

৩। কিছু ন্যায়পরায়ণ উলামা উল্লেখ করেন যে, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব হলেন হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ (ইসলামী সংস্কারক)। অনেকে তার প্রসঙ্গে বহু বই-পুস্তকও রচনা করেন। ঐ লেখকদের মধ্যে শায়খ আলী ত্বত্বাবী অন্যতম, যিনি ঐতিহাসিক আদর্শ ও প্রতিভাবান মহাপুরুষদের প্রসঙ্গে এক ধারাবাহিক পুস্তক রচনা করেছেন। যাদের মধ্যে তিনি শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এবং আহমদ বিন ইরফানের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি ঐ পুস্তকে ঐ কথাও উল্লেখ করেন যে, ভারতে তওহীদের আকীদা পৌছে মুসলিম হাজীগণের মাধ্যমে যারা মক্কায় হজ্জ করতে এসে ঐ আকীদায় প্রভাবান্বিত হয়ে দেশে ফিরেন।

পরে ইংরেজ ও ইসলাম-দুশমনরা ঐ আকীদার বিরুদ্ধে বাধ সাধে। কারণ ঐ আকীদায় তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেছিল। তাই অর্থলোভী স্বার্থপর (মুসলিম)দের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তাদের বদনাম করতে প্রয়াস চালায়। ফলে তওহীদের প্রতি আহবানকারী প্রত্যেক তওহীদবাদীর নাম (তুচ্ছভাবে) ওয়াহাবী রাখে[২] এবং এইরূপ বলে কোন অভিনব দ্বীন প্রবর্তক (বিদআতী) রূপে তাকে চিহ্নিত করতে চায়। যাতে মুসলিমরা তাদের মূল তওহীদের আকীদা থেকে ফিরে আসে, যে আকীদা তাদেরকে কেবল এক আল্লাহকে ডাকার প্রতি আহবান করে। কিন্তু সে নির্বোধরা একথা বুঝতে পারেনি যে, ওয়াহাবী” শব্দটি ‘আল-ওয়াহহাব’এর সহিত সম্বদ্ধ; যা আল্লাহর পবিত্র নামাবলীর অন্যতম নাম। (যার অর্থ মহাদা) যিনি তাকে (ওয়াহাবীকে) তওহীদ দান করেছেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

[১]. এখন যদি বিশুদ্ধ তওহীদের দাওয়াতকে কেউ ফিতনা মনে করে তবে ন্যায় পরায়ণ জ্ঞানীর নিকট ফিতনাবা কে তা সহজে অনুমেয়। (অনুবাদক)

[২]. যা ইতিহাসে ওয়াহাবী আন্দোলন’ বলে সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ। (অনুবাদক)

 তওহীদ ও শির্কের সংঘর্ষ

১। তওহীদের সহিত শির্কের সংঘর্ষ প্রাচীন। এ সংঘর্ষ প্রথম শুরু হয় সেই রসূল (সা.) নুহ 21-এর যুগে যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করার এবং মূর্তিপূজা বর্জন করার প্রতি আহবান করেন। তাদের মাঝে সাড়ে নয়শত বছর অবস্থান করে তওহীদের দাওয়াত দিতে থাকলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবিধান ছিল -যেমন কুরআন উল্লেখ করে,

وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا * وَقَدْ أَضَلُّوا كَثِيرًا

অর্থাৎ, ওরা বলল, তোমরা তোমাদের দেব-দেবীকে পরিত্যাগ করো না; অদ, সুয়া, য়্যাগুস, য়্যাউক ও নাকে । ওরা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। (সূরা নূহ ২৩-২৪ আয়াত)

ইমাম বুখারী ইবনে আব্বাস এই আয়াতের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন যে, এগুলি নুহ সম্প্রদায়ের (৫টি) নেক লোকের নাম ছিল। যখন তারা পরলোক গমন করলেন, তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে কুমন্ত্রণা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করল যে, ওঁরা যে মজলিসে উপবেশন করতেন সে মজলিসে ওঁদের মুর্তি নির্মাণ করে সংস্থাপন কর এবং ওঁদের নাম অনুসারে প্রত্যেকের নাম রেখে দাও।” লোকেরা তাই করল। তখন তাদের পূজা করা হত না। কিন্তু যখন ঐ লোকেরা মারা গেল এবং ঐশী-জ্ঞান বিস্মৃত হল তখন ঐ মূর্তিসমূহের পূজা শুরু হয়ে গেল।

২। অতঃপর নূহ (আঃ)-এর পর আরো বহু রসূল এলেন। তারা স্ব-স্ব সম্প্রদায়কে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে এবং বাতিল মাবুদসমূহের ইবাদত বর্জন করতে আহবান করলেন যারা ইবাদতের যোগ্য ছিল না। শুনুন কুরআন কি বলছে। সে আপনাকে খবর দেবে--

وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ

অর্থাৎ, এবং আদ জাতির নিকট ওদের ভ্রাতা হূদকে প্রেরণ করেছিলাম। সে। বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন মাবুদ নেই। তোমরা কি সাবধান হবে না ?” (সূরা আ’রাফ ৬৫ আয়াত)

وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ

অর্থাৎ, এবং সামূদ জাতির প্রতি তাদের ভ্রাতা সালেহকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর; তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন উপাস্য নেই।” (সূরা হূদ ৬১ আয়াত)

وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ

অর্থাৎ, এবং মাদয়্যানবাসীদের নিকট তাদের ভ্রাতা শুআইবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন মাবুদ নেই।” (সূরা ৮৪ আয়াত)

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِّمَّا تَعْبُدُونَ * إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ

অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইব্রাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলেছিল, 'তোমরা যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই; সম্পর্ক আছে শুধু তারই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন। করবেন।' (সূরা যুখরুফ ২৬-২৭ আয়াত)

কিন্তু যুগে যুগে মুশরিকরা দ্বন্দ্ব, প্রতিবাদ এবং সর্বপ্রকার শক্তি ও সামর্থ ব্যয় করে সংঘর্ষ দ্বারা সকল আম্বিয়াগণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে।

৩। আমাদের প্রিয় রসূল (সা.) যিনি নবুয়তের পূর্বে আরবের নিকট সত্যবাদী বিশ্বস্ত বলে সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত ও তওহীদ বরণ এবং পিতৃপুরুষদের পূজ্যমান উপাস্যসমূহ বর্জন করতে আহবান করলেন, তখন সকলে তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততাকে ভুলে বসল। বরং উল্টো তাকে ‘যাদুকর মিথুক’ বলে অভিহিত করল। কুরআন তাদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে বলে,

وَعَجِبُوا أَن جَاءَهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ ۖ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ * أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, এরা আশ্চর্যান্বিত যে, এদেরই মধ্য হতে এদের নিকট একজন সতর্ককারী এল! এবং কাফেররা বলল, এ তো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী। এ কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে একটি মাত্র উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এ তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার!’ (সূরা স্বাদ ৪-৫ আয়াত)।

كَذَٰلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ * أَتَوَاصَوْا بِهِ ۚ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ

অর্থাৎ, এরূপে এদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রসূল (সা.) এসেছে, তখনই ওরা তাকে বলেছে, (তুমি তো) এক যাদুকর অথবা পাগল। ওরা কি একে অপরকে এ মন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুতঃ ওরা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। (সূরা যারিয়াত ৫২-৫৩ আয়াত)

এই তো তওহীদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে সকল রসূলের ভূমিকা এবং অপর পক্ষে তাদের মিথ্যায়নকারী ও অপবাদ আরোপকারী সম্প্রদায়দের এই ভূমিকা!

৪। আমাদের বর্তমান যুগে মুসলমান যদি মানুষকে সদাচরণ, সত্যবাদিতা ও আমানতদারী প্রভৃতির প্রতি দাওয়াত দেয়, তাহলে তার কোন বিরোধী দৃষ্ট হয়। কিন্তু যখন সে সেই তওহীদের প্রতি আহবান করে; যে তওহীদের প্রতি রসূলগণ আহবান করে গেছেন -আর তা হল একমাত্র আল্লাহকে ডাকা এবং তিনি ছাড়া আম্বিয়া, আওলিয়া যারা আল্লাহরই দাস তাদেরকে না ডাকা -তখন লোকে তার বিরোধিতা শুরু করে দেয়, তার নামে মিথ্যা অপবাদ রটায় এবং বলে, ও তো ওয়াহাবী!! আর এই বলে তার দাওয়াত থেকে মানুষকে বাধা। দান করে। এমন কি ওদের নিকট কোন এমন আয়াত পাঠ করা হয় যাতে তওহীদের উল্লেখ আছে, তবে তা শুনে ওদের কেউ কেউ বলে, 'এটা ওয়াহাবী আয়াত!!

অনুরূপ ওদের নিকট “যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহরই নিকট কর” এই হাদীস উপস্থাপন করা হয় তখন কিছু লোক বলে, 'এটা ওয়াহাবী হাদীস!’ নামাযী যদি নামাযে তার হাত দুটিকে বুকের উপর রাখে অথবা তাশাহহুদে তর্জনী হিলায় -যেমন রসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন -তাহলে লোকে তাকে দেখে (নাক সিটকে) বলবে, এতে ওয়াহাবী!’ সুতরাং ওয়াহাবী’ সেই তওহীদবাদী মুসলিমের এক প্রতীকরূপে পরিচিত হয়ে পড়েছে, যে কেবলমাত্র তার প্রভু ও প্রতিপালককেই ডাকে এবং তার নবী (সা.)র সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ করে। পরন্তু ওয়াহাবী’ ‘আল-ওয়াহহাব’ (মহাদাতা)-এর প্রতি সম্বদ্ধ; যা আল্লাহর পবিত্র নামাবলীর অন্যতম নাম। যিনি তওহীদবাদীকে তওহীদ দান করেছেন, যা আল্লাহর তরফ হতে তওহীদবাদীদের জন্য বৃহত্তম অনুগ্রহ ও দান।

৫। তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের জন্য জরুরী, ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর রসূলের কথা স্মরণ করে মনকে প্রবোধ দান করা, যাকে আল্লাহ বলেছিলেন,

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

অর্থাৎ, ওরা যা বলে, তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে ওদেরকে উপেক্ষা করে চল। (সূরা মুযযাম্মিল ১০ আয়াত)

فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا

অর্থাৎ, তোমার প্রতিপালকের ফায়সালার জন্য ধৈর্য ধারণ কর এবং ওদের মধ্যে পাপাচারী ও কাফেরদের আনুগত্য করো না। (সূরা দাহর ২৪ আয়াত)।

৬। সকল মুসলিমের উপর ওয়াজেব, তারা যেন তওহীদের দাওয়াতকে সাদরে গ্রহণ করে এবং তওহীদের প্রতি আহবানকারীকে ভালোবাসে। যেহেতু তওহীদ সাধারণভাবে সমস্ত রসূল (সা.)গণের এবং (বিশেষভাবে) আমাদের রসূল (সা.) মুহাম্মাদ এক-এর দাওয়াত। সুতরাং যে ব্যক্তি রসূল (সা.)-কে ভালোবাসে, সে । তওহীদের দাওয়াতকে ভালোবাসে এবং যে তওহীদকে ঘৃণা বাসে, সে আসলে রসূল (সা.)-কেও ঘৃণা বাসে।।

 বিধান ও কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহরই

আল্লাহ বিশ্বজগৎ রচনা করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যুগে যুগে রসূল পাঠিয়েছেন। রসূলের প্রতি ঐশীগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে হক ও ন্যায়ের সাথে মানুষের মাঝে বিচার ও ফায়সালা হয়। যে বিচার-সংবিধান আল্লাহর বাণী ও রসূল (সা.)-এর উক্তিরূপে আমাদের নিকট মজুদ রয়েছে, যে বিধান ইবাদত, ব্যবহার, বিশ্বাস, ধর্মনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি মানুষের অন্যান্য কর্ম ও বিষয়ে পরিব্যাপ্ত।।

১- আকীদাহ বা বিশ্বাসের বিধানঃ রসূলগণ প্রথম যে বিষয় দ্বারা তাদের দাওয়াত আরম্ভ করেন, তা হল আকীদার সংশুদ্ধি এবং তওহীদ (একত্ববাদ)এর প্রতি মানুষকে আহ্বান। সুতরাং ইউসুফ ৭৫° কারাগারে তার দুই সঙ্গীকে তওহীদের প্রতি আহবান করলেন; যখন তারা তাদের স্বপ্নবৃত্তান্ত সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন বৃত্তান্ত বলার পূর্বে তিনি বললেন,

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ * مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, হে কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, না এক পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁকে ছেড়ে তোমরা যাদের উপাসনা করছ, তা তো কতকগুলি নাম মাত্র, যা তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা রেখে নিয়েছে, যার কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠান নি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কারো তোমরা উপাসনা করো না। এটিই সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে অবগত নয়। (সূরা ইউসুফ ৩৯-৪০ আয়াত)

২ – ইবাদত সমূহে বিধানঃ নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জ প্রভৃতি ইবাদতের যাবতীয় বিধান কুরআন ও সহীহ হাদীস হতে গ্রহণ করা আমাদের জন্য ওয়াজেব ও জরুরী। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “তোমরা সেই রূপে নামায পড় যে রূপে আমাকে পড়তে দেখেছ।” (বুখারী ও মুসলিম) “তোমরা আমার নিকট হতে হজ্জের বিধান গ্রহণ কর। (শিখে নাও।)”

আর সকল আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনগণ বলে গেছেন, হাদীস সহীহ হলে সেটাই আমার মযহাব।”

সুতরাং ইমামগণ কোন এক বিষয়ে পরস্পর মতভেদ করলে আমরা কারো উক্তির অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করব না। বরং উদারচিত্তে তারই কথা ও মতের পক্ষপাতিত্ব করব যার কথার প্রমাণে কিতাব ও সুন্নাহ হতে সহীহ দলীল দেখব।*

৩। ক্রয়-বিক্রয়, লেন-দেন, ঋণ ও ভাড়া দেওয়া-নেওয়া প্রভৃতি ব্যবহারিক জীবনের বিধানও একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অধীনে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অর্থাৎ, না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! ওরা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা ওদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার তোমার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার বিচারে ওদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে। তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা ৬৫ আয়াত)

ব্যাখ্যাতাগণ এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেন যে, জমির সেচ নিয়ে দুই ব্যক্তি আপোসে কলহ-বিবাদ করে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন নবী (সা.) -এর ফুফুতো ভাই যুবাইর। তারা রসূল (সা.) এর নিকট বিচারপ্রার্থী হলে তার বিচার যুবাইরের অনুকুলে হল। তিনি তাকেই তার প্রতিপক্ষের পুর্বে সেচের অধিকার দিলেন। অপর লোকটির প্রতিকূলে বিচার হলে সে তাকে বলল, 'ও আপনার ফুফুতো ভাই কিনা, তাই ওর সপক্ষে আপনি বিচার করলেন! এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হল। (বুখারী)। ৪। দন্ডবিধি ও সমপ্রতিশোধ দন্ডের বিধানও আল্লাহর। তিনি বলেন,

وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

অর্থাৎ, আর আমি তাদের জন্য ওতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদল প্রাণ, চক্ষুর বদল চক্ষু, নাসিকার বদল নাসিকা, কর্ণের বদল কর্ণ, দন্তের বদল দন্ত এবং জখমের বদল অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে ওতে তারই পাপ মোচন হবে। আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অত্যাচারী। (সূরা মায়েদাহ ৪৫ আয়াত)।

৫ - দ্বীন ও ধর্মনীতির বিধান দেবার সকল অধিকারও আল্লাহর। তিনি বলেন,

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ

অর্থাৎ, তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি--- (সূরা শুরা ১৩ আয়াত)

মুশরিকরা দ্বীনি-বিধান রচনা করার ক্ষমতা গায়রুল্লাহকে দিয়েছিল, তাই আল্লাহ তাদের প্রতিবাদ করে বলেন,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ

অর্থাৎ, ওদের কি কতকগুলি অংশীদার (আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্য) আছে যারা ওদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা ২১ আয়াত)

সারকথাঃ

সার কথা এই যে, কিতাব ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করা, তদনুসারে জীবন পরিচালনা করা এবং উভয়ের নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়া সমস্ত মুসলিমের জন্য ওয়াজেব। যেহেতু আল্লাহর নির্দেশ,

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ

অর্থাৎ, এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তুমি তদনুযায়ী ওদের মধ্যে বিচার-নিষ্পত্তি কর। (সূরা মায়েদাহ ৪৯ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “--এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নেতারা (শাসক গোষ্ঠী ও ইমামগণ) আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিধান (ও ফায়সালা) না দেয় এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা বরণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব বহাল রাখেন।” (হাসান ইবনে মাজাহ প্রভৃতি বর্ণনা করেছেন।

মুসলিমদের জন্য এও ওয়াজেব যে, তারা যেন নিজেদের দেশ ও রাষ্ট্র থেকে বিদেশী আইন যেমন ইউরোপীয়, ফরাসী প্রভৃতি কানুন - যা ইসলামী কানুনের পরিপন্থী তা বাতিল করে এবং সেই সমস্ত বিচারালয়ে বিচারপ্রার্থী না হয়। যেখানে ইসলামী আইনের পরিপন্থী আইন দ্বারা বিচার-মীমাংসা করা হয়। বরং আস্থাভাজন উলামাদের নিকট ইসলামী সংবিধানের কাছে নিজেদের বিবাদবিসম্বাদের বিচার প্রার্থনা করবে। আর এটাই তাদের জন্য শ্রেয়। কারণ ইসলাম তাদের মাঝে ন্যায্য বিচার করে প্রত্যেকের ন্যায্য প্রাপ্য প্রদান করবে।

আর এতে তাদের বহু অর্থ ও সময় বাচবে; যা রাষ্ট্রীয় আদালত সমূহে অনর্থক কোন উল্লেখযোগ্য উপকার ছাড়াই বিনষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া মানুষের মনগড়া কানুনের নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়াতে কিয়ামতে বড় শাস্তি তো আছেই। কারণ তারা আল্লাহর ন্যায়পরায়ণ আইন ও বিচার হতে বৈমুখ্য প্রকাশ করে যালেম সৃষ্টির গড়া আইন ও বিচারের আশ্রয় নেয়।

* প্রকাশ যে, চার মযহাবের একটার তকলীদ (অন্ধানুকরণ) করা ওয়াজেব’-কথাটি ভিত্তিহীন। ইমামগণ নিজেরাই এর খন্ডন করে গেছেন। রাহেমাহুমুল্লহু আজমাঈন। এ বিষয়টি সাদিসম্মতও নয়। বরং এটা ছিল বিবাদ ও ফিতনা এড়াবার মানসে Principle of excluded middle- এর নীতি। -অনুবাদক।

 সর্বাগ্রে আকীদাহ অথবা ইসলামী শাসন?

মক্কা মুকারামার দারুল হাদীসে অনুষ্ঠিত এক ভাষণে মহান দ্বীন-প্রচারক মুহাম্মাদ কুতুব উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। মূল প্রশ্নটি নিম্নরূপঃ

প্রশ্ন - কিছু লোক বলে থাকে যে, ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার মাধ্যমেই ইসলাম ফিরে আসবে। কিন্তু অন্য কিছু লোক বলে যে, আকীদাহর সংশুদ্ধি এবং সাধারণ তরবিয়তের মাধ্যমেই ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব হবে। এই দুই অভিমতের কোনটি সঠিক?

উত্তরঃ পৃথিবীর বুকে এই দ্বীনের শাসন-ব্যবস্থা কোথা হতে আসবে -যদি দাওয়াতপেশকারীরা আকীদাহর পরিশুদ্ধি সাধন না করে ও লোকেরা সঠিক ঈমানের মুমিন না হয়; যারা তাদের দ্বীনে ক্লিষ্ট হলে ধৈর্য ধারণ করবে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করবে? এরূপ হলে তবেই পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন (ইসলামী শাসন) প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। এতো খুব স্পষ্ট ব্যাপার। শাসক তো আর আকাশ হতে আসবে না, আকাশ হতে অবতীর্ণ হবে না। অবশ্য প্রত্যেক বস্তু তো আসমান (আল্লাহর তরফ ) হতেই আসে। কিন্তু তা মানুষের তদবীর ও প্রচেষ্টায়; যা আল্লাহ মানবজাতির উপর ফরয করেছেন। তিনি বলেন,

وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ

অর্থাৎ, আল্লাহ ইচ্ছা করলে (শাস্তি দিয়ে বা ধ্বংস করে) ওদের নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধের বিধান দিয়ে তিনি এককে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। (সূরা মুহাম্মদ ৪ আয়াত)

সুতরাং আকীদার পরিশুদ্ধি এবং বিশুদ্ধ আকীদার উপর জনগোষ্ঠীর তরবিয়ত ও প্রশিক্ষণ সর্বাগ্রে শুরু করা আমাদের জন্য জরুরী। যাতে এমন জনগণ তৈরী হয় যারা নিপীড়িত ও বিপদগ্রস্ত হলে অকাতরে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে যেমন আমাদের প্রথম (পূর্ব)পুরুষ (সাহাবাগণ) সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।

 শির্কে আকবর ও তার প্রকারভেদ

শির্ক আকবর (বড় শির্ক) তখন হবে যখন আপনি কাউকে আল্লাহর সমতুল্য বা সমকক্ষ (শরীক) স্থাপন করবেন। তাকে আপনি ডাকবেন; যেমন আল্লাহকে ডাকেন অথবা কোন প্রকার ইবাদত -যেমন বিপদে সাহায্য প্রার্থনা, যবেহ, ন্যর-নিয়াজ প্রভৃতি তার জন্য নিবেদন করবেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইবনে মসউদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) -কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কোন পাপ সর্বপেক্ষা বড়?” উত্তরে তিনি বললেন, “তোমার আল্লাহর সমকক্ষ স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সমকক্ষ অর্থাৎ সমতুল্য ও অংশীদার)।

শির্কে আকবরের প্রকারভেদ

১ দুআয় (প্রার্থনা ও ডাকার) শির্কঃ- রুজী অনুসন্ধান, রোগ নিরাময় প্রভৃতির উদ্দেশ্যে আম্বিয়া, আওলিয়া ইত্যাদি গায়রুল্লাহকে ডাকলে বা প্রার্থনা করলে এই শির্ক হয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে আহবান করো না যে তোমার কোন উপকার করে না এবং অপকারও করে না। যদি তা কর, তাহলে তুমি যালেম (মুশরিক)দের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ইউনুস ১০৬ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে কোন শরীক (উপাস্য) কে ডাকা অবস্থায় মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (বুখারী)

আল্লাহ ব্যতীত মৃত বা জীবিতদেরকে (বিপদে) ডাকা বা তাদের নিকট কিছু প্রার্থনা করা (যা তাদের দেবার সাধ্য নেই) শির্ক। এ কথার দলীল আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِن قِطْمِيرٍ * إِن تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ ۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ

অর্থাৎ, এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা অতি তুচ্ছ। (খেজুরের আঁটির উপর পাতলা আবরণেরও) মালিক নয়। তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তোমাদের আহবান তারা শুনবে না, আর শুনলেও তোমাদেরকে সাড়া দেবে না। তোমাদেরকে কিছুও দান করতে পারে না)। কিয়ামতের দিন তোমাদের ঐ শির্ককে তারা অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ। (আল্লাহর) ন্যায় তোমাকে কেউই অবহিত করতে পারবে না। (সূরা ফাতির ১৩-১৪ আয়াত)

২। আল্লাহর গুণাবলীতে শিকঃযেমন এই বিশ্বাস যে, আম্বিয়া ও আওলিয়াগণ গায়েব (অদৃশ্যের খবর) জানেন। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ- তাঁর নিকটেই গায়েবের চাবি। তিনি ব্যতীত তা আর কেউ জানে। না। (সূরা আনআম ৫৯ আয়াত)

৩। মহব্বতের শির্কঃ তা হল, আওলিয়া প্রভৃতিকে এমন ভালোবাসা ও ভক্তি করা যেমন আল্লাহকে ভালোবাসা ও ভক্তি করা হয়। এর দলীল আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ

অর্থাৎ, কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পরিবতে (তার) বিভিন্ন সমকক্ষ স্থির করে তাদেরকে এমন ভালোবাসে; যেমন আল্লাহকে বাসা হয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর ভালোবাসায় সুদৃঢ়। (সূরা বাক্বারাহ ১৬৫ আয়াত)

৪৷ আনুগত্যের শির্কঃ

তা হল বৈধ মনে করে আল্লাহর অবাধ্যাচরণে (নাফরমানী করে) উলামা (ইমাম) ও পীর-বুযুর্গদের আনুগত্য করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

অর্থাৎ, তারা আল্লাহর পরিবর্তে ওদের পন্ডিত (পাদরী) ও সংসার বিরাগীদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা তাওবাহ ৩১ আয়াত)

ওরা ওদের এক প্রকার উপাসনা করত। যে উপাসনার ব্যাখ্যা হল, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করে এবং তিনি যা হালাল করেছেন তা হারাম করে পাপ কাজে তাদের আনুগত্য করা।

মহানবী (সা.) বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যাচরণ করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

৫। সর্বেশ্বরবাদের শির্কঃ

অর্থাৎ এই বিশ্বাস যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিতে আবির্ভূত। এই বিশ্বাস দেমাঙ্কে সমাধিস্থ সুফী ইবনে আরাবীর। এমনকি সে বলেছে,

প্রভু তো দাস, আর দাস হল প্রভু,

হায় যদি আমি জানতে পারতাম, ‘মুকাল্লাফ’

(শরীয়তের আজ্ঞাপ্রাপ্ত) কে ?!’

সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ভিন্ন এক সুফী কবি বলেছে,

‘কুকুর-শুকরও আমাদের উপাস্যই,

আল্লাহ তো গীর্জায় অবস্থানকারী পাদরীও!’(*)

৬ - নিয়ন্ত্রণকর্মের শির্কঃ এই বিশ্বাস যে, কিছু আওলিয়ার বিশ্ব-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, যারা বিশ্বকর্ম পরিচালনা করে থাকেন! যাঁদেরকে ‘কুতুব’ বলা হয়।

অথচ আল্লাহ তাআলা প্রাচীন মুশরিকদেরকে এই বলে প্রশ্ন করেন,

وَمَن يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ

অর্থাৎ,---এবং কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে?’ তখন তারা বলবে, ‘আল্লাহ।' (সূরা ইউনুস ৩১আয়াত)।

৭- ভয়ের শির্কঃ

এই বিশ্বাস যে, কিছু মৃত অথবা অনুপস্থিত আওলিয়ার প্রভাব ও অনিষ্ট করার ক্ষমতা আছে যা ঐ বিশ্বাসীর মনে ভয় সঞ্চার করে ফলে ওদেরকে ভয় করে। এই বিশ্বাস ছিল মুশরিকদের। এর প্রতি সতর্ক করে কুরআন বলে,

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ ۖ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ

অর্থাৎ, আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের ভয় দেখায়। (সূরা যুমার ৩৬ আয়াত)

অবশ্য হিংস্র জন্তু এবং জীবিত কোন অত্যাচারী ব্যক্তি হতে প্রকৃতিগত ভয় শির্কের পর্যায়ভুক্ত নয়।

৮ - বিধান রচনার শির্কঃ

(৮) এই মতবাদে বিশ্বাসী জনৈক কবি এক জলাশয়ের প্রান্তে বসে থেকে দেখল যে,পদাপাতার উপর একটি ব্যাঙ বসে আছে। ইতিমধ্যে একটি সাপ তাকে আক্রমণ করতে চাইলে সে পানির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে সে গায়,

‘হরির উপরে হরি হরি শোভা পায়,

হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়!’-অনুবাদক

যে ব্যক্তি ইসলাম-পরিপন্থী বিধান প্রণয়ন ও প্রচলন করে মানুষের মনগড়া কানুনকে মানা বৈধ মনে করে অথবা ইসলামী সংবিধানকে অচল ভাবে তার এই শির্ক হয়। এতে শাসক ও শাসনাধীন ব্যক্তি এবং বিচারক ও বিচারাধীন ব্যক্তি সকলেই এই শির্কের পর্যায়ভুক্ত হবে, যদি বিচারাধীন ব্যক্তি ঐ কানুনে বিশ্বাসী ও ঐ বিচারে সন্তুষ্ট হয় তবে।

৯ - শির্কে আকবর আমল বিধংস করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থাৎ, অবশ্যই তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, যদি তুমি শির্ক কর তাহলে নিশ্চয় তোমার আমল (সৎকর্ম) নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার ৬৫ আয়াত)

১০। সম্পূর্ণরূপে শির্ক ত্যাগ করে তওবা না করা পর্যন্ত আল্লাহ শির্কে আকবরের পাপ ক্ষমা করবেন না। তিনি বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا

অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সহিত শির্ক করার পাপ ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্যান্য পাপ যার জন্য ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দেন। আর যে আল্লাহর সহিত শির্ক করে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। (সূরা নিসা ১১৬ আয়াত)।

১১। শির্ক বহু প্রকারের। যার কিছু শির্কে আকবর এবং কিছু আসগর; যা থেকে সতর্ক থাকা ওয়াজেব। রসূল ঐ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন এই দুআ করি,

اللهم إنا نعوذ بك من أن نشرك بك شيئا نعلمه و نستغفرك لما لا تعلم

উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা ইন্না নাউযু বিকা মিন আন নুশরিকা বিকা শাইআন না’লামুহ, অনাস্তাগফিরুকা লিমা লা নালাম।

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমরা তোমার সহিত আমাদের কোন জানা বিষয়ে শরীক করা হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং অজানা বিষয়ে শির্কের পাপ হতে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (ইমাম আহমাদ হাদীসটিকে হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন।)

 গায়রুল্লাহকে আহবানকারীর উপমা

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ ۚ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ ۖ وَإِن يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَّا يَسْتَنقِذُوهُ مِنْهُ ۚ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ

অর্থাৎ, হে মানুষ! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর ? তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক, তারা তো কক্ষনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না -যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে সকলে একত্রিত হয়। আবার মাছি যদি তাদের নিকট হতে কিছু নিয়ে চলে যায়, তবে তাও তারা তার নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থী ও প্রার্থিত উভয়ই অক্ষম। (সূরা হজ্জ ৭৩ আয়াত)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সম্বোধন করে মহান উপমাটি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতে আদেশ করেন। তিনি বলেন, ঐ আওলিয়া, সালেহীন প্রভৃতিগণ; যাদেরকে তোমরা বিপদে সাহায্য লাভের জন্য আহবান করছ তারা তোমাদের সাহায্য করতে অক্ষম। বরং তারা কোনও এক সৃষ্টি যেমন একটি মাছিও সৃজন করতে অসমর্থ। আবার মাছি যদি তাদের খাদ্য অথবা পানীয়র কিছু অংশ নিয়ে চলে যেতে চায়, তবে তাও ফিরিয়ে আনতে তারা সক্ষম হবে না। এ তাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার এবং মাছিরও হীনতা ও ক্ষীণতার দলীল। সুতরাং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা তাদেরকে কি ভেবে আহবান করছ ? অত্র উপমায় তাদের বিরুদ্ধে ঘোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে যারা আম্বিয়া, আওলিয়া প্রভৃতি গায়রুল্লাহকে বিপদে ডেকে থাকে।

২। আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ ۖ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ ۚ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ

অর্থাৎ, সত্য আহবান তারই। যারা তাঁকে ব্যতীত অন্যকে আহবান করে ওরা তাদেরকে কোন সাড়াই দেয় না, তাদের দৃষ্টান্ত সেই (পিপাসার্ত) ব্যক্তির মত, যে তার মুখে পানি পৌছবে এই আশায় তার হস্তদ্বয় এমন পানির দিকে প্রসারিত করে যা তার মুখে পৌছবার নয়। কাফেরদের আহবান তো নিষ্ফল। (সূরা রা'দ ১৪ আয়াত)

উক্ত আয়াতে এ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, দুআ (আহবান ও প্রার্থনা), যা মুল ইবাদত তা একমাত্র আল্লাহরই জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত। ওরা যে। আল্লাহকে ছেড়ে অপরকে আহবান করছে তাতে ওরা ওদের নিকট কোন উপকার লাভ করবে না। আর ওল্লাও (গায়রুল্লাহ) ওদেরকে কোন প্রকার সাড়াও দেবে না, কোন সাহায্যও করতে পারবে না। তাদের উপমা সেই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে এক কুঁয়ার উপর দন্ডায়মান থেকে হাত বাড়িয়ে পানি নিয়ে মুখে দেওয়ার অপচেষ্টা করে; যা তার সাধ্যে নয়। (যেহেতু সে পানি তার নাগালের বাইরে।)

মুজাহিদ বলেন, সে নিজের জিহ্বা দ্বারা পানিকে ডাকে এবং ইশারা করে কিন্তু পানি কক্ষনোই মুখে এসে পৌছে না।” (ইবনে কাসীর) অতঃপর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে ডাকে তাদের সম্পর্কে তিনি ফায়সালা দেন যে, তারা কাফের এবং তাদের ঐ আহবান ভ্রষ্টতা ও নিষ্ফল। যেহেতু তিনি বলেন, কাফেরদের আহবান তো নিষ্ফল।

অতএব ভাই মুসলিম! গায়রুল্লাহকে ডেকে কাফের ও ভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে সাবধান হন। আর একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহকেই ডাকুন। এতে আপনি তওহীদবাদী মুমেনদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

 শির্ক দূরীকরণের উপায়

তিন প্রকার শির্ক দূর না করে আল্লাহর সহিত শির্ক দূর করা সম্পন্ন ও সম্ভব হবে নাঃ

১। প্রতিপালকের কর্মসমূহে শির্কঃ এই বিশ্বাস যে, আল্লাহর সহায়ক কোন ভিন্ন সৃষ্টিকর্তা অথবা নিয়ন্তা আছে। যেমন কিছু সুফীপন্থী মনে করে যে, আল্লাহ তাআলা কিছু বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ-ভার তার কিছু আওলিয়া ও কুতুবকে সমর্পণ করেছেন! যে বিশ্বাসের বিশ্বাসী প্রাক, ইসলাম যুগের মুশরিকরাও ছিল না। তাই তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও তারা ওদের মত উত্তর দেয়নি। আল্লাহ বলেন,

وَمَن يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ

অর্থাৎ, কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে? তারা বলবে, আল্লাহ।' (সূরা ইউনুস ৩১ আয়াত)

এক সুফী লেখকের বই ‘আলকা-ফী ফিরদ্দি আলাল অহহা-বীতে পড়েছি, লেখক বলেন, 'আল্লাহর এমন অনেক বান্দা আছে যারা কোন কিছুর উদ্দেশ্যে হও’ বললে সাথে সাথে তা হয়ে যায়! অথচ কুরআন তার এই কথার মিথ্যায়ন ও খন্ডন করে। আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ

অর্থাৎ, তিনি যখন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন (তার প্রতি ইঙ্গিত করে) কেবল হও’ বললে তা হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসীন ৮২ আয়াত)

অন্যত্রে তিনি বলেন, (أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ) অর্থাৎ জেনে রাখ, সৃষ্টি করা ও নির্দেশ দান কেবল তারই কাজ। (সূরা আরাফ ৫৪ আয়াত)

২। ইবাদত ও দুআতে শির্কঃ আল্লাহর ইবাদত করা ও তাকে ডাকার সাথে সাথে অন্যান্য আম্বিয়া আওলিয়া ও সালেহীনদেরকেও ডাকা। যেমন তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা বিপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে তাদেরকে আহবান করা। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, এই শির্ক বর্তমান উম্মাহর মাঝে বহুল প্রচলিত। এই মহাপাপের অধিকাংশ বহন করবেন সেই পীর বুযুর্গ ও আলেমরা যারা অসীলার নামে এই ধরনের শির্ককে সমর্থন করে থাকেন এবং তাকে ভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন। যেহেতু অসীলা মানা হল কাউকে মাধ্যম করে আল্লাহরই নিকট প্রার্থনা করা। কিন্তু ওরা যা করে থাকে তা তো সরাসরি গায়রুল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা করা। যেমন ওরা বলে, মদদ ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ ‘মদদ ইয়া জীলানী! অথবা মদদ ইয়া বদবী!’ (মদদ ইয়া খাজা! মদদ ইয়া আলী!) আর এই যাচনাই হল গায়রুল্লাহর উপাসনা। যেহেতু তা দুআ ও ফরিয়াদ। আর নবী (সা.) বলেন, “দুআই তো ইবাদত (উপাসনা)।” (তিরমিযী, এব তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। পক্ষান্তরে মদদ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট চাওয়া বৈধ নয়। তিনি বলেন,

وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ

অর্থাৎ, তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা মদদ (সমৃদ্ধ) করবেন। (সূরা নূহ ১২ আয়াত)

৩ শাসন ও বিচারের শির্কঃ ইবাদতের শির্কের পর্যায়ভুক্ত যদি শাসক বা বিচারক অথবা শাসনাধীন বা বিচারাধীন ব্যক্তি আল্লাহর বিধান ও কানুনকে অচল মনে করে অথবা তার বিধান ও কানুন ব্যতীত অন্য বিধান ও কানুন অনুযায়ী শাসন ও বিচার বৈধ মনে করে।

৪। আল্লাহর গুণাবলীতে শির্কঃ

আল্লাহর কোন কোন সৃষ্টি যেমন আম্বিয়া, আওলিয়া প্রভৃতিকে আল্লাহ আযযা অজাল্লার বিশিষ্ট কোন কোন গুণ দ্বারা গুণান্বিত করা। যেমন উদাহরণ স্বরূপ, গায়েবী খবর জানা।

এই প্রকার শির্ক সূফীপন্থী এবং এদের দ্বারা প্রভাবান্বিত লোকদের মাঝে ব্যাপক প্রচলিত। যেমন বুসীরী নবী (সা.) প্ল-এর প্রশংসা করে বলেছে, ‘হে নবী (সা.) পৃথিবী ও তার অফুরন্ত সম্পদ তোমার বদান্যতারই অংশ, লওহে মাহফুয ও কলমের ইলমও তোমার অগাধ ইলমের অন্তর্ভুক্ত!! এখান হতেই কিছু ধর্মজী দাজ্জালদের ভ্রষ্টতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। যারা ধারণা করে যে, তারা রসূল -কে জাগ্রতাবস্থায় দেখে থাকে এবং তাদের। সহচরবর্গকে তাদের কোন কোন বিষয়ে দায়িত্বভার দেবার পূর্বে তাকে ওদের অন্তস্তলের গুপ্ত রহস্য প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে। অথচ রসূল ঐ তার জীবদ্দশায় এ ধরনের রহস্য জানতে পারতেন না। যেমন তাঁর তরফ থেকে কুরআন বলে,

وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ

অর্থাৎ, আমি যদি গায়েব (অদৃশ্যের খবর) জানতাম, তবে তো আমি প্রভূত। কল্যাণ লাভ করতাম এবং অকল্যাণ আমাকে স্পর্শই করত না। (সূরা আরাফ ১৮৮৮)

সুতরাং ইহকাল ত্যাগ করার পর এবং সুমহান বন্ধুর নিকট চলে যাওয়ার পর তিনি গায়েবের খবর কি রূপে জানতে পারেন? তিনি এক বালিকাকে যখন কবিতায় বলতে শুনলেন, “আমাদের মাঝে এমন নবী (সা.) আছেন; যিনি আগামীকালের অবস্থা জানেন।” তখন তিনি বললেন, “এই কথাটি ছেড়ে দাও (বলো না) বাকী যেগুলি বলছিলে সেগুলি বল।”

অবশ্য আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূলগণকে কোন কোন গায়েবী বিষয়ে অবহিত করে থাকেন। যেমন তিনি বলেন,

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَدًا * إِلَّا مَنِ ارْتَضَىٰ مِن رَّسُولٍ

অর্থাৎ, তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তাঁর অদৃশ্যের (গায়েবী) জ্ঞান। কারো নিকট প্রকাশ করেন না। তার মনোনীত রসূল ব্যতীত। (সূরা জিন ২৬-২৭)

 তওহীদবাদী কে?

উক্ত তিন প্রকার শির্ক থেকে আল্লাহকে যে পবিত্র করবে এবং তার সত্তা, ইবাদত, দুআ, এবং গুণাবলীতে তাকে একক ও অদ্বিতীয় মানবে সেই হল। তওহীদবাদী। তার জন্য রয়েছে তওহীদবাদীদের মত বিশিষ্ট মর্যাদা। আর যে ব্যক্তি ঐ তিন প্রকার শির্কের কোন এক প্রকার আল্লাহর জন্য স্থাপন করবে সে। তওহীবাদী হবে না। বরং তার পক্ষে আল্লাহ তাআলার এই বাণী সঙ্গত হবে। তিনি বলেন,

وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, ওরা যদি শির্ক করত তাহলে ওদের সমস্ত কৃতকর্ম পণ্ড হয়ে যেত। (সূরা আনআম ৮৮ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থাৎ, তুমি যদি শির্ক কর তবে তোমার আমল নিষ্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদ&#